ব্রাজিল-কলম্বিয়া ম্যাচ এলেই যে কঠিন দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়!

শেষ অঙ্কে পা রেখেছে কোপা আমেরিকার গ্রুপ পর্বের লড়াই। গ্রুপ ডি’র শেষ দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা নিশ্চিত করতে আগামীকাল বুধবার (৩ জুলাই) মাঠে নামবে ব্রাজিল। এই ম্যাচে নয়বারের চ্যাম্পিয়নদের প্রতিপক্ষ দুরন্ত ফর্মে থাকা কলম্বিয়া। এই ম্যাচে কলম্বিয়ার সঙ্গে ড্র করলেই কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা নিশ্চিত হবে ব্রাজিলের। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কোয়ার্টার ফাইনালে পড়তে হবে উরুগুয়ের সামনে। হারলে চোখ রাঙাচ্ছে বিদায়।

যে কোনো টুর্নামেন্টে অটো ফেবারিট বলা যায় ব্রাজিলকে। বিশ্বফুটবলে প্রতিভার আঁতুড়ঘর বলা হয় তাদেরই। স্মরণকালের ইতিহাসে সেই ব্রাজিল এবারই প্রথম কোনো টুর্নামেন্ট শুরু করেছে ফেবারিটের তালিকার বাইরে। এমনকি কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিতের জন্য গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে কলম্বিয়ার বিপক্ষে আন্ডারডগ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে তাদের। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে জয় পেতেই ভুলতে বসেছিল দলটি। সবশেষ ম্যাচে প্যারাগুয়েকে ৪-১ গোলে হারানোর আগে টানা পাঁচ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে জয়হীন ছিল সেলেকাওরা।

নতুন কোচ দরিভাল জুনিয়রের অধীনে ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড পার করছে ব্রাজিল। দলে প্রতিভার অভাব নেই। আছেন ভিনিসিউস জুনিয়র, রদ্রিগো, এন্দরিকদের মতো তারকা। কিন্তু মাঠে তাদের রসায়ন ঠিকঠাক জমে ওঠেনি এখনও। অন্যদিকে কলম্বিয়া পার করছে স্বর্ণযুগ। আর্জেন্টাইন কোচ নেস্টর লরেঞ্জোর অধীনে ২২ ম্যাচে ১৭ জয় ও ৫ ড্র নিয়ে এবারের কোপা আসরের অন্যতম ফেবারিট তার দল। কোপায় প্রথম দুটি ম্যাচে প্যারাগুয়েকে ২-১ এবং কোস্টারিকাকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে লরেঞ্জোর দল। এর আগে গত বছর বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে কলম্বিয়ার কাছে হেরেছিল ব্রাজিল। তাই বড় পরীক্ষার মুখেই ব্রাজিল।

কলম্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের লড়াইয়ের ইতিহাসটা তিক্ততার। দুই দলের ম্যাচ এলেই অনেকের মনে কড়া নাড়ে এক দশক আগের এক ঘটনা। যেদিনটা ব্রাজিলের ফুটবলের অন্যতম কালো দিন। বলতে গেলে ব্রাজিলের ফুটবল ওহমে চরম আঘাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলম্বিয়ার নাম।

২০১৪ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ব্রাজিল। নেইমার জুনিয়রের উত্থানে সেবার ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর ছিল তারা। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে এই কলম্বিয়ার সঙ্গেই মুখোমুখি হয়েছিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ফোর্তোলেজায় সে ম্যাচটা দুই ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা ও ডেভিড লুইজের গোলে ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল ব্রাজিলই। উঠে গিয়েছিল সেমিফাইনালেও। ষষ্ঠ বিশ্বকাপ থেকে মাত্র দুই ধাপ দূরে তখন ব্রাজিল।

কিন্তু সে ম্যাচেই অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয় সেলেকাওরা। ম্যাচের এক পর্যায়ে বল দখলের লড়াইয়ে কলম্বিয়ার উইংব্যাক হুয়ান ক্যামিলো জুনিগার চ্যালেঞ্জে মারাত্মক আহত হন ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকা নেইমার। জুনিগার হাঁটুর আঘাতে ভার্টিব্রার হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যান ২২ বছর বয়সী নেইমার।

এই ঘটনায় অবশ্য জুনিগাকে কার্ড দেখানো তো দূরের কথা ফাউল পর্যন্ত ধরেননি রেফারি। পরবর্তীতে অনেকেই দাবি করেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই জুনিগা নেইমারকে আঘাত করেছিলেন। কিন্তু সেই দাবি তিনি অস্বীকার করেন। ব্রাজিলের অধিনায়ক থিয়াগো সিলভাও বলেন, জুনিগা এমন মানুষ না যে ইচ্ছাকৃতভাবে একজন খেলোয়াড়ের ক্ষতি করবেন। তবে এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রকাশ্যেও নেইমারের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন জুনিগা।

তাতে অবশ্য ব্রাজিলের ক্ষতিপূরণ হয়নি। মিনেইরোর স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালে নেইমারকে ছাড়া মাঠে নেমে ব্রাজিল শিকার হয়েছিল তাদের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির। জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়ে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছিলেন ডেভিড লুইজ, হুলিও সিজাররা। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় হার। বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে এটাই কোনো দলের সবচেয়ে বড় হারের লজ্জা।

সেই ট্র্যাজেডি কাটিয়ে উঠতে ব্রাজিলের সময় লেগেছে বেশ। সেদিন মাঠে থাকা খেলোয়াড়দের জন্য দিনটি এখনও দুঃস্বপ্নের। সেই ম্যাচে ৭ গোল হজম করা গোলরক্ষক হুলিও সিজারের ক্যারিয়ারের সব অর্জন বলতে গেলে ধুলায় মিশে গেছে। ইন্টারের হয়ে ট্রেবল জেতা, ব্রাজিলের মতো দলের হয়ে কোপা আমেরিকা ও কনফেডারেশন্স কাপ জেতা গোলরক্ষককে মানুষ মনে রাখছে সাত গোল হজম করা গোলরক্ষক হিসেবে। ব্রাজিলকে ২০০২ সালে সবশেষ বিশ্বকাপ এনে দেয়া কোচ লুইজ ফেলিপ্পে স্কলারি এই ঘটনার পর হারান চাকরি।

আর নেইমার? – এই ঘটনাকে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে মুহূর্ত বলে আখ্যা দিয়েছিলেন নেইমার। এই ইনজুরিতে তার ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিল অনেকেই। এমনকি নেইমার পুনরায় আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারবেন কি-না, তা নিয়েও ছিল শঙ্কা। তবে সৌভাগ্যবশত সেরে উঠে ফের ফুটবলে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি। এরপর বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। পিএসজিকে জিতিয়েছেন লিগ ওয়ান। ব্রাজিলকে এনে দিয়েছেন তাদের ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণ। পেলেকে ছাড়িয়ে হয়েছেন ব্রাজিলের জার্সিতে সর্বোচ্চ গোলের মালিক। কিন্তু ইনজুরি নামের অভিশাপ তার পর থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নেইমারকে। ব্রাজিলকেও এখন পর্যন্ত এনে দিতে পারেননি তাদের পরম আকাঙ্ক্ষিত হেক্সা তথা ষষ্ঠ বিশ্বকাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *