free tracking

ড. ইউনূসের কাছ থেকে পরবর্তী সরকারপ্রধানরা যা শিখতে পারেন!

বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সরকারে যত জনই থাক, এক ব্যক্তির হাতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে। গত ৫৩ বছর যাঁরা সরকারপ্রধান হয়েছেন, তাঁরা অপরিসীম এবং অতুলনীয় ক্ষমতা উপভোগ করেছেন। তাঁরা যা বলেছেন, সেটাই আইন।

তাঁরা যা ইচ্ছা করেছেন, সেভাবেই দেশ পরিচালিত হয়েছে। ভুল, শুদ্ধ যা-ই হোক না কেন, তাঁদের কথাই শেষ কথা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মন্ত্রী, সচিবসহ সরকারের সবাই সরকারপ্রধানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য। প্রতিদিন সরকারপ্রধানের ব্যস্ততা থাকত চোখে পড়ার মতো।

গত ১৫ বছর বাংলাদেশের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে ক্ষমতা ছিল, সেই ক্ষমতা রাজতান্ত্রিক কোনো দেশের রাজার হাতেও ছিল না। বাংলাদেশ ছিল আসলে সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শাসিত একনায়কতান্ত্রিক সরকার। যদিও বলা হয়েছিল, আমাদের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করলে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

তিনি ছাড়া বাস্তবে আর কারো তেমন ক্ষমতা নেই।
ড. আকবর আলি খান তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে দেশ শাসনে একক কর্তৃত্ব দিয়ে মূলত সংবিধানেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে যাই থাকুক না কেন, একজন ব্যক্তির যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তিনি যদি সবার মতামতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে চান, তিনি যদি দায়িত্ব বণ্টন করে সব দায়িত্ব সমন্বিত করতে চান, তাহলে সংবিধান বাধা নয়। গত সাত মাসে আমরা তার প্রমাণ পেলাম। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাত মাসে দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে সরকারপ্রধানকে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

কিভাবে সম্মিলিতভাবে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করা যায়।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে সংস্কৃতি চালু তা হলো—সরকারপ্রধান সারাক্ষণ টেলিভিশনের পর্দায় থাকবেন। তিনি একাধিক অনুষ্ঠান করবেন। তাঁর কর্মব্যস্ততা দেখানোই হলো সব সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনের প্রধান লক্ষ্য। এক দিন তিনি দৃশ্যপটের আড়ালে থাকলেই হুলুস্থুল হয়ে যেত। কিন্তু আমরা গত সাত মাসে টেলিভিশনের পর্দায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতি কম দেখেছি। তিনি যখন উপস্থিত হন তখন যৌক্তিকভাবে উপস্থিত হন। তাঁর উপস্থিতি দেখা যায় নীতিনির্ধারণী এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। এ কারণে মানুষ তাঁর কথা শোনে। তিনি অযাচিতভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ছোট-বড় নানা রকম কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে একই রকম বক্তৃতার চর্বিতচর্বণ করেন না। যার ফলে তাঁর প্রতিটি কথার মধ্যে এক ধরনের চিন্তা-দর্শন থাকে। মানুষ সেই কথাগুলোকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং ধারণ করার চেষ্টা করে। আমরা অতীতে দেখেছি, তামিম ইকবালের অবসর গ্রহণ থেকে শুরু করে সাবিনাদের বেতন না পাওয়া কিংবা চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার পর দুস্থদের কী হবে—সব কিছুই যেন প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়। এসব ছোটখাটো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আসে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া যেন কিছুই হয় না। একজন পিয়নের বদলি থেকে শুরু করে একটি শবদেহ দাফনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে সবাই তাকিয়ে থাকে। মন্ত্রীরা কোনো কাজ করেন না। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী কী নির্দেশনা দিচ্ছেন, সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দেখা যেত, ফাইল পড়ে আছে। কারণ এ ব্যাপারে মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন, তারপর দেখা যাবে। ছোটখাটো সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছিল দৃষ্টিকটু পর্যায়ে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী একজন মানুষ। ১৮ কোটি মানুষের একটা দেশ এককভাবে তাঁর পরিচালনা করা অসম্ভব ব্যাপার। সব বিষয়ে মনোযোগ দিতে গিয়ে আসল কাজটিই ঠিকঠাক মতো হতো না। এই প্রথা ভেঙে দিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেখা যাচ্ছে, কোনো বিষয়েই তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। গত সাত মাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় স্বাধীন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এই সরকারের অনেক ব্যর্থতা আছে, অনেক ভুলত্রুটি আছে এ কথাও সত্যি। কিন্তু কোনো উপদেষ্টা কোনো সিদ্ধান্তের জন্য প্রধান উপদেষ্টা দিকে তাকিয়ে থাকছেন না বা প্রধান উপদেষ্টার মতামতের জন্য অপেক্ষা করছেন না। ধরা যাক, বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের কথা, সেখানে যে নাটক হলো, অতীতে যদি এমনটি হতো তাহলে নির্ঘাত এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দেখা যেত। হয়তো নারী ফুটবলাররা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন। কিন্তু বিষয়টা বাফুফের। এ কারণে প্রধান উপদেষ্টা তো নয়ই, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করেনি। সব বিষয়ে যে সরকারপ্রধানকে কথা বলতে হয় না, এটা প্রধান উপদেষ্টা শেখালেন।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করছেন। পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন তাঁর প্রেস সচিব। শুধু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান এবং মনোভাব প্রকাশ করছেন তাঁর প্রেস সচিব। এটি আসলে গণতান্ত্রিক রীতি এবং শিষ্টাচার। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে এটি চালু করলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভুল, শুদ্ধ যেভাবে করুন, নিজ উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছেন। সব মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারাও তাঁদের মতো করে কাজ করছেন। এর ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সবচেয়ে ইতিবাচক যে অর্জনটি হয়েছে তা হলো, প্রতিটি মন্ত্রণালয় স্বকীয়, স্বাধীন ও সৃজনশীলতার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে তাদের মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ততা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে সচিব পর্যন্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারছেন এবং শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন নতুন সচিব নিয়োগ হয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি, এসব নিয়োগ হতো পুরোপুরিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্ষমতাবান আমলারা তাঁদের খেয়াল খুশিমতো বন্ধুবান্ধব, কাছের লোকজনকে যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক সচিব বানিয়ে দিতেন। কিন্তু এবার ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই সরকার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। এ ব্যাপারে একটি বোর্ড গঠিত হয়েছে। বোর্ড সচিব পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের বিষয় পর্যালোচনা করছে এবং সব কিছু দেখে শুনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। প্রশাসনের এই বিকেন্দ্রিকরণ এবং প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার যে সুযোগ—এটি অতীতে আমরা কখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এটি করছেন এবং এর ফলে কাজে স্বচ্ছতা এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা পুরো রাষ্ট্র এবং দেশ নিয়ে ভাবনার সময় পাচ্ছেন। নীতিনির্ধারণী বিষয়ে তিনি মনোযোগ দিতে পারছেন। এর ফলে বাংলাদেশ নীরবে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন করছে। একটি দেশের সরকারপ্রধান যদি পিয়ন-দারোয়ান নিয়োগ, ক্রিকেটার আর ফুটবলারদের দলে থাকা-নাথাকা ইত্যাদি ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন কিভাবে?

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রধান উপদেষ্টা সব সময় বিভিন্ন উপদেষ্টার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। এই বৈঠকগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে। অতীতে আমরা দেখেছি, মন্ত্রীরাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহজে সাক্ষাত্ পেতেন না। তাঁদের দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা বাসভবনের পিয়ন, চাকরদের ধরতে হতো। এখন পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেকোনো উপদেষ্টা সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাঁরা যেতে পারেন এবং যেকোনো সংকট নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতে পারেন। অর্থাত্ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেভাবে চলতে পারে সেভাবে চলার একটি রূপকল্প গত সাত মাসে উপস্থাপন করেছেন ড. ইউনূস।

সরকার কোনো ব্যক্তির না। সরকার হলো একটি সমষ্টি, গ্রুপ। ড. ইউনূস প্রায়ই বলেন, এটি হলো খেলার টিমের মতো। এখানে সবাই যদি সমানভাবে পারফরম্যান্স না করে তাহলে যেমন একটা দল ভালো করতে পারে না, ঠিক তেমনি সরকারের সবাই যদি সম্মিলিতভাবে যার যার দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে সরকারও কার্যকর হয় না। আর সেই সুব্যবস্থাপনার একটি প্রয়োগ আমরা গত সাত মাসে দেখছি। একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজগুলো হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সরকার একটি অন্তর্বর্তী সরকার। কাজেই ভবিষ্যতে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবেন, সরকার গঠন করবেন তাঁরা এ ধরনের সমন্বিতভাবে দেশ পরিচালনার শিক্ষাটা নিতে পারেন। এককভাবে সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাইলে কেউ কোনো কাজ করে না। সবাই সরকার প্রধানের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং রাষ্ট্র ভুল পথে পরিচালিত হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেখালেন সম্মিলিত শক্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়। আইন বা সংবিধান সেখানে বাধা না। নিজের ইচ্ছাটাই যথেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *