free tracking

ভারত ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ স্থগিত করে পাকিস্তানকে কি সংকটে ফেলতে পারবে?

পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ‘সিন্ধু পানি চুক্তি’ স্থগিত করেছে। ভারতের পানি শক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি বৃহস্পতিবার তার সমকক্ষ পাকিস্তানের সচিব সৈয়দ আলী মুর্তজাকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠিতে এই স্থগিতাদেশের ঘোষণা দেন।

চিঠিতে ভারত অভিযোগ করে, ‘জম্মু ও কাশ্মীরকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানের ধারাবাহিক আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ’ এবং চুক্তি পুনর্বিবেচনায় পাকিস্তানের অনিচ্ছাই এই সিদ্ধান্তের কারণ। চুক্তির ৬৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম স্বাক্ষরকারী একপক্ষ এমন চরম পদক্ষেপ নিয়েছে।

পাকিস্তান ভারতের এই সিদ্ধান্তকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) এক বৈঠকের পর দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, সিন্ধু পানি চুক্তি একটি বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হয়েছে এবং এটিকে একতরফা স্থগিতাদেশের কোনো বিধান নেই।

এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদী (সতলজ, বিয়াস ও রাভি) এবং পাকিস্তান তিনটি পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী (সিন্ধু, ঝেলাম ও চেনাব) নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়। এখন চুক্তি থেকে ভারতের একতরফা সরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের সামনে কি কোনো বিকল্প রয়েছে?

এনএসসির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান তার অধিকার অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করতে পারে; যার মধ্যে শিমলা চুক্তিও রয়েছে। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান যদি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করা শুরু করে, তাহলে ভারত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অভিযোগও জানাতে পারবে না। অপরদিকে, পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের কাছে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে পারে।

প্রথমত, এটা বোঝা জরুরি যে, সিন্ধু পানি চুক্তিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা ভারতের এটাই প্রথম নয়। এই চুক্তিটি ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের জেনারেল আইয়ুব খানের মধ্যে করাচিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও এটি টিকে ছিল। ১৯৭০ সালে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায় চেনাব নদীর উপর সালাল বাঁধ নির্মাণ করে চুক্তি লঙ্ঘন করে। তবুও এই চুক্তি ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও টিকে ছিল।

পরবর্তীতে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে তার সরকার বিশ্বব্যাংকে সালাল বাঁধ নিমার্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায় এবং ভারতকে বাঁধটি নকশা পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়। এরপর সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে ১৯৭৮ সালে ভারত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে। এ চুক্তির ফলে বাঁধের স্পিলওয়ে গেটের উচ্চতা ৪০ ফুট থেকে ৩০ ফুটে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয় ভারত।

সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন ভারতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ইলিফ। ছবি: বিশ্বব্যাংক
ভারত চুক্তিটিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন হিসেবে ঘোষণা করে। তবে ভারতের পানি বিশেষজ্ঞরা এটিকে ঝেলাম, চেনাব এবং সিন্ধু নদীর পানি ঘুরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় বাধা বলে মনে করতেন। ২০০১ সালে ভারতের সংসদ ভবনে হামলার পর দেশটি পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি স্থগিতের হুমকি দিয়েছিল। বিগত তথ্যপ্রমাণ থেকে এটি স্পষ্ট, ভারত বারবার সন্ত্রাসবাদের অজুহাত তুলে এই চুক্তিকে স্থগিত করার চেষ্টা করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের লক্ষ্য ছিল ঝেলাম ও চেনাব নদীর উপর আরও বেশি বাঁধ নির্মাণ।

২০০৭ সালে ভারত কাশ্মীর উপত্যকার বান্দিপুরার উত্তরে ঝেলাম নদীর উপর কিশনগঙ্গা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকে অভিযোগ জানালে প্রকল্প স্থগিত করতে হয় ভারতকে। পরে বিষয়টি সালিশি আদালতে পাঠানো হয়, যা এখনো বিচারাধীন।

পুনরায় ২০১৩ সালে ভারত কাশ্মীরের কিশ্তওয়ার জেলায় চেনাব নদীর উপর রাতলে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। পাকিস্তান আবারও বিশ্বব্যাংকে অভিযোগ করলে, ভারত নকশায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারত আবার চুক্তটি বাতিলের হুমকি দেয়। অনেক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান ভারতের চেয়ে বেশি পানি পায়। প্রকৃতপক্ষে, এই দাবিটি ভুল।

 

গত বছর ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু পাকিস্তান ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। এরপর সর্বশেষ পেহেলগামে হামলার পর ভারত সরকার চুক্তিটি স্থগিতের ঘোষণা দেয় এবং প্রচার করে, ‘পানি অবরোধ’ করে পাকিস্তানকে ভয়াবহ পানি সংকটে ফেলা হবে।

তবে অনেক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ বিজেপি সরকারের এই দাবির সঙ্গে একমত নন। ইন্ডিয়া টুডে-তে অভিষেক দে লেখেন, ‘চুক্তি স্থগিত মানেই তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া যাবে এমন নয়; কারণ ভারতের হাতে এখনো সেই পরিকাঠামো নেই, যার মাধ্যমে সিন্ধু নদীর পানি থামিয়ে দেওয়া বা নিজের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। ভারত সর্বোচ্চ ৫-১০% পানি প্রবাহ কমাতে পারে।’

এই নদীগুলোর উপর বড় রিজার্ভার নির্মাণ করতে ভারতের কয়েক বছর লেগে যাবে। এর জন্য বিস্তৃত জরিপ এবং বিশাল অর্থের প্রয়োজন। পাকিস্তান এই প্রকল্পগুলোর কারণে দশ বছর পর সমস্যায় পড়তে পারে।

এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারত সরকার মিথ্যা দাবি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এর বিপরীতে পাকিস্তান যদি শিমলা চুক্তি স্থগিত করে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ভারতই বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। বর্তমানে পাকিস্তানের হাতে শিমলা চুক্তি স্থগিতের অনেক যুক্তি রয়েছে। ভারত ১৯৮৪ সালে সিয়াচিন হাইটস দখল করে এ চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল। পরবর্তীতে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের মর্যাদা পরিবর্তন করে ভারত আবারও চুক্তিটি লঙ্ঘন করে।

এখন কল্পনা করা যাক, পাকিস্তান যদি শিমলা চুক্তি থেকে সরে আসে তাহলে কী কী হতে পারে। প্রথমত, পাকিস্তান আর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শর্তে আবদ্ধ থাকবে না এবং কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্থতার পথ খুলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা অন্য যে কোনো দেশ কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতা করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধবিরতির রেখা (সিএফএল) হিসেবে বিবেচিত হবে, যা কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক হবে।

আন্তর্জাতিকভাবে কোনো আইন নেই যা যুদ্ধবিরতির রেখা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। ভারত হয়তো ভাবতেও পারছে না, শিমলা চুক্তি স্থগিত হলে কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। ভারতের তথাকথিত ‘পানি অবরোধ’ হয়তো পাকিস্তানকে একেবারে শুকিয়ে ফেলবে না, কিন্তু পাকিস্তানের ‘শিমলা অবরোধ’র পর ভারত নিজেই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অনুবাদ: খালিদ হাসান

হামিদ মির: পাকিস্তানি সাংবাদিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *