সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা অনেকেই যে কাজটি প্রথম করি, তা হলো স্মার্টফোন আনলক করা। চোখ পুরোপুরি খুলে ওঠার আগেই আমরা সোশ্যাল মিডিয়া, মেসেজ, ইমেইল বা নিউজ চেক করতে থাকি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনি যখন আপনার ফোনটি আনলক করেন, তখন আপনি নিজের অজান্তেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে শেয়ার করে ফেলছেন? আধুনিক প্রযুক্তি ও অ্যান্ড্রয়েড বা আইফোন সিস্টেমে এমনভাবে সফটওয়্যার ও ট্র্যাকিং টুল বসানো থাকে যে, আপনি মনে করছেন ফোনটি শুধু আপনার, অথচ সেটি প্রতিনিয়ত তথ্য পাঠাচ্ছে নানা অ্যাপ, সার্ভার ও কোম্পানির কাছে।
প্রথমত, আপনি নিজের লোকেশন বা অবস্থান শেয়ার করে ফেলছেন। ফোন চালু হতেই সেটি জিপিএস বা লোকেশন ট্র্যাকিং শুরু করে দেয়। আপনি কোথায় ঘুমিয়েছেন, সকাল কয়টায় ঘুম থেকে উঠেছেন, কোথায় যাচ্ছেন—সবই গুগল ম্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এমনকি ওয়েদার অ্যাপ পর্যন্ত জানতে পারে। আপনি লোকেশন সার্ভিস বন্ধ করলেও কিছু অ্যাপ ডিভাইসের আইপি, ওয়াইফাই বা মোবাইল টাওয়ার থেকে আপনার অবস্থান অনুমান করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আপনি জানিয়ে দিচ্ছেন আপনার ঘুমের ধরন ও রুটিন। আপনি কখন ঘুমাতে গেছেন এবং কখন ঘুম ভেঙেছে, তা আপনার ফোনের স্ক্রিন অন/অফ টাইম, চার্জিং সময় এবং মোবাইল ব্যবহারের ধরন দেখে বুঝে ফেলা যায়। স্বাস্থ্য অ্যাপ বা ঘড়ির সঙ্গে যুক্ত থাকলে আরও নির্ভুলভাবে জানানো যায় আপনি কত ঘন্টা ঘুমালেন, ঘুম কেমন ছিল ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, আপনি দিচ্ছেন আপনার আগ্রহ বা মনোযোগের দিক সম্পর্কে তথ্য। আপনি কোন অ্যাপ প্রথম খুললেন—ফেসবুক না নিউজ, হোয়াটসঅ্যাপ না ইউটিউব? আপনি কোন পোস্টে থামলেন বেশি সময়, কী ধরনের কনটেন্টে স্ক্রল করলেন না, তা থেকেই আপনার রুচি, মানসিক অবস্থা বা রিফ্রেশমেন্ট চাহিদা নির্ণয় করে অ্যাপগুলো।
চতুর্থত, আপনি জানাচ্ছেন আপনার ফোনের অবস্থান ও অবস্থা। ফোন কত সময় চার্জে ছিল, এখন কত পার্সেন্ট চার্জ আছে, কোন নেটওয়ার্কে সংযুক্ত, ওয়াইফাই নাকি মোবাইল ডাটা, এমনকি আপনার ফোনের ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন চালু আছে কিনা—এসব কিছু নিরীক্ষণ করে কিছু অ্যাপ তাদের সার্ভারে পাঠিয়ে দেয়।
পঞ্চমত, আপনি শেয়ার করছেন আপনার ব্যবহৃত পাসওয়ার্ড ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংক্রান্ত তথ্য। যদিও এসব তথ্য এনক্রিপ্টেড থাকে, অনেক অ্যাপ বা সার্ভিস চায় আপনি যেন তাদের বায়োমেট্রিক অথেন্টিকেশন সক্রিয় করেন। এতে তারা জানে আপনি সকালে আপনার ফিঙ্গার দিয়ে বা ফেস আইডি দিয়ে ফোন আনলক করেছেন। এটি প্রযুক্তির নিরাপত্তা বাড়ায় ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে আপনাকে শনাক্ত করাও সহজ করে।
ষষ্ঠত, আপনি দিচ্ছেন আপনার মুড বা মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সংকেত। আপনি সকালে কোনো গান প্লে করলেন, না হোয়াটসঅ্যাপে কারো মেসেজ খুললেন, কিংবা কোনো সংবাদপত্রে নেতিবাচক খবর পড়লেন—এসবের ভিত্তিতে আপনার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যালগরিদম।
সপ্তমত, আপনি শেয়ার করছেন আপনার আর্থিক বা কেনাকাটার আগ্রহ। আপনি যদি সকালে প্রথমেই কোনো শপিং অ্যাপে ঢোকেন, তাহলে সিস্টেম ধরে নেয় আপনি হয়ত কেনাকাটার চিন্তায় আছেন। আপনি যদি কোনো ব্যাংক অ্যাপ খুলে থাকেন, সেটাও একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত। অনেক ফিনটেক অ্যাপ আপনার সাম্প্রতিক খরচ, ব্যালেন্স বা ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাক করে নেয়।
অষ্টমত, আপনি জানিয়ে দিচ্ছেন আপনার সম্পর্কের অবস্থা বা সংযোগ। আপনি কাকে মেসেজ করেছেন, কার ফোন মিস করেছেন, কাকে ফোন দিয়েছেন, সকাল সকাল কার পোস্টে লাইক দিয়েছেন—এসব থেকেও আপনার সম্পর্ক, পছন্দের মানুষ বা ঘনিষ্ঠতার ধরন বিশ্লেষণ করা যায়।
নবমত, আপনি জানাচ্ছেন আপনার শারীরিক অবস্থা। যদি আপনি হেলথ অ্যাপ, ওয়্যারেবল ডিভাইস বা স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করেন, তাহলে আপনার ধাপ সংখ্যা, হার্টবিট, অক্সিজেন লেভেল ইত্যাদি তথ্য সকালের শুরুতেই ফোনে আপডেট হয়ে যায়। যেসব হেলথ অ্যাপ এসব ডেটা সংগ্রহ করে, তারা সেগুলো বিক্রি করতে পারে তৃতীয় পক্ষকে।
দশমত, আপনি সরাসরি না করলেও ফোন নিজেই শেয়ার করছে আপনার আচরণগত প্যাটার্ন বা অভ্যাস। আপনি সকালে ঠিক কয়টায় ফোন আনলক করেন, কোন সময় স্ক্রিনে সবচেয়ে বেশি থাকেন, আপনি কি রাতে বেশি ফোন ব্যবহার করেন নাকি সকালে, এসব দীর্ঘ সময় ধরে ট্র্যাক করে কোম্পানিগুলো আপনার অভ্যাসের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন তৈরি করে।
এই ১০টি বিষয় ছাড়াও আরও অনেক ছোটখাটো তথ্য আপনি প্রতিনিয়ত শেয়ার করছেন, যেমন কোন ভাষায় ফোন ব্যবহার করেন, কী ধরনের কীবোর্ড ইনস্টল করা আছে, আপনি কোন বিজ্ঞাপন স্কিপ করেন আর কোনটা দেখেন, এমনকি আপনি টাইপ করতে গিয়ে কী ভুল করেন তাও।
সব মিলিয়ে, আমাদের প্রতিদিনের সকালের সেই নিরীহ কাজ—“ফোন আনলক”—আসলে একটি টেকনোলজিক্যাল ঘটনাপুঞ্জ, যার প্রতিটি ধাপে ছড়িয়ে যায় ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। যতটা সম্ভব অ্যাপ পারমিশন সীমিত রাখা, লোকেশন বন্ধ রাখা, অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ আনইনস্টল করা, এবং প্রাইভেসি সেটিংস নিয়মিত আপডেট করা আমাদের ডিজিটাল জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে যে আমরা নিজেদের তথ্য প্রতিনিয়ত বিলিয়ে দিচ্ছি, সে সত্যটিও অস্বীকার করা যায় না। আর তাই, ফোনে হাত রাখার আগেই ভাবুন— আপনি আসলে ঠিক কী শেয়ার করতে যাচ্ছেন।
Leave a Reply