free tracking

পুরুষদের চেয়ে নারীরা হৃদরোগে বেশি মারা যান কেন?

পুরুষদের চেয়ে নারীরা হৃদরোগে বেশি মারা যান কেন? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং চিন্তার বিষয়। সাধারণ ধারা হল, মানুষ মনে করে হৃদরোগে পুরুষরাই বেশি ভোগে এবং মারা যায়। কিন্তু প্রকৃত তথ্য দেখালে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী নারীরাও হৃদরোগে অনেক বেশি আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ করে হৃদরোগে নারীদের মৃত্যুর হার পুরুষদের চেয়ে অনেক সময় বেশি হয়। এর পেছনে অনেক কারণ কাজ করে, যা আমরা এখানে সহজ বাংলায় বোঝার চেষ্টা করবো।

প্রথমত, নারীদের শরীর ও হার্টের রোগের উপস্থাপনা পুরুষদের থেকে আলাদা হয়। অর্থাৎ, যখন একজন পুরুষের হার্টে সমস্যা হয়, তখন সে সাধারণত বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু নারীরা অনেক সময় অন্য ধরনের উপসর্গ দেখায়, যেমন বুকে ব্যথা না থাকলেও কাঁধ, পিঠ, গলা বা চোয়ালে ব্যথা হতে পারে। আবার মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, অবসাদ বা বমি বমি ভাবও নারীদের হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে। এই ভিন্ন লক্ষণগুলো অনেক সময় চিকিৎসক কিংবা রোগী উভয়ের কাছেই সহজে বোঝা যায় না। ফলে হৃদরোগের সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসা পেতে নারীরা অনেক সময় দেরি করে।

দ্বিতীয়ত, নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে হরমোনের ভূমিকা আছে। মহিলাদের মাসিক বন্ধ হওয়ার পর, অর্থাৎ মেনোপজের পর, তাদের শরীরের ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যায়। ইস্ট্রোজেন হার্ট এবং রক্তনালীর স্বাস্থ্য ভালো রাখার কাজ করে। এই হরমোন কমে যাওয়ার কারণে নারীদের রক্তনালীতে চর্বি জমার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই অনেক নারীরা মেনোপজের পর থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

তৃতীয়ত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে নারীরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে অনেক সময় পিছিয়ে থাকে। অনেক দেশে এখনও নারীরা স্বাস্থ্যের বিষয়ে পুরুষদের চেয়ে কম গুরুত্ব দেয় অথবা পরিবারের অন্য দায়িত্বে এত ব্যস্ত থাকে যে নিজের শরীরের সমস্যা লুকিয়ে রাখে। তারা দেরিতে ডাক্তারের কাছে যায় বা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারে না। এর ফলে রোগ ধরা পড়ে অনেক সময় খুবই শেষ পর্যায়ে, যা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়।

চতুর্থত, নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার অনেক বিষয় প্রভাব ফেলে। বর্তমানে অনেক নারী কর্মজীবী এবং পরিবারের অন্যান্য কাজের চাপেও থাকে। শরীরচর্চার অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, ধূমপান এবং অ্যালকোহল গ্রহণ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এই রোগের কারণ হতে পারে। অনেক নারী নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নয় অথবা প্রয়োজনীয় সময় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করান না।

পঞ্চমত, হৃদরোগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈষম্যও একটি বড় সমস্যা। নারীদের হৃদরোগের চিকিৎসায় অনেক সময় পুরুষদের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নারীদের হৃদরোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা যেমন ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি বা কেট স্ক্যান কম হতে পারে। চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয় কিংবা সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয় না। এর ফলে নারীদের হৃদরোগ থেকে সুস্থ হওয়া অনেক কঠিন হয়।

অন্যদিকে, নারীরা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সচেতন হলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ ও রক্তে চিনি ঠিক রাখা এবং স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি ধূমপান ও মদ্যপান এড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সময়মতো চিকিৎসা করালে হৃদরোগ থেকে মৃত্যু রোধ করা যায়।

সর্বোপরি, হৃদরোগ নারীদের জন্য পুরুষদের মতোই বড় হুমকি। আমাদের সমাজে নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে আরও সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা জরুরি। নারীদের হৃদরোগের লক্ষণ ও ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা সময়মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে পারে। এইভাবে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।

পুরুষদের চেয়ে নারীরা হৃদরোগে বেশি মারা যাওয়ার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণে ভিন্ন উপসর্গ, হরমোনের পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অসুবিধা, জীবনযাত্রার চাপ এবং চিকিৎসার বৈষম্য। এই কারণগুলো মিলে নারীদের হৃদরোগে মৃত্যু হার অনেক সময় বেশি হয়ে থাকে। তাই নারীদের জন্য হৃদরোগ একটি বড় স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ, যার প্রতি আমাদের সবাইকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *