ক্লাস টুতে পড়া আট বছর বয়সী ছোট্ট শিশু নাফির ছুটি হয়েছিল আগেই। তার মা আর একই স্কুলের ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী খালাতো বোনের সঙ্গে বসে সে অপেক্ষা করছিল তার ক্লাস সিক্সে পড়া বড় বোন নাজিয়ার ছুটি হওয়ার জন্য। দুপুর ১টা ১০-এর দিকে নাজিয়ার ছুটি হলে তাকে আনতে তার ক্লাসের দিকে যায় নাফি। স্কুল প্রাঙ্গণে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি ঘটে ঠিক সেই সময়ে।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নাজিয়া ও নাফি দুজনেই দগ্ধ হয় এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর ওদের মৃত্যু হয়।
স্বজনরা জানায়, জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নাজিয়াকে যখন তার পরিবারের সদস্যরা খুঁজে পায়, সে বারবার জিজ্ঞেস করছিল তার ভাই কেমন আছে। ‘নাজিয়া বলছিল– আমাকে দেখে নাফি দৌড়ে আসে, নয়তো ওর কিছুই হতো না।’
কথাগুলো বলছিলেন নাজিয়ার খালা তানজিনা আখতার, যিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাসপাতালে নাজিয়ার সঙ্গে ছিলেন।
শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নাজিয়া মারা যায় সোমবার ভোররাতে। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় বারবার যেই ছোট ভাইয়ের খোঁজ নিচ্ছিল সে, সেই নাফি মারা গেছে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে। তার শরীরে বার্ন ছিল ৯৫ শতাংশ।
বুধবার দুপুরে টঙ্গীর কাছে রাজাবাড়ী এলাকার বাসার নিচে যখন নাফির মরদেহ আনা হয়, তখন তার মা শেষবার তার ছেলেকে একটু আদর করতে আসেন। আট বছর বয়সী ছেলের ছোট্ট শরীর এতটাই পুড়ে গিয়েছিল যে সেখানে থাকা মানুষজন সংক্রমণের আশঙ্কায় তার মাকে মরদেহে শেষ চুমুটা দিতেও বাধা দেয়।
কারণ নাফি আর নাজিয়ার মা তাহমিনা আখতার প্রায় ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
সোমবার দুপুরে বিমান দুর্ঘটনার সময় স্কুলের বাইরে থাকলেও দুর্ঘটনার পরপর তাৎক্ষণিকভাবে সন্তানদের খুঁজে পাননি তাহমিনা আখতার। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে তারা খবর পান যে নাজিয়া আর নাফিকে উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
দুই শিশুর মামা মোহাম্মদ রুম্মান বলেন, শুরুতে শুনি উত্তরা আধুনিক মেডিক্যালে নেওয়া হয়েছে, তার কিছুক্ষণ পর জানতে পারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর আমাদের বলা হয় যে পাশের বার্ন ইউনিটে (জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে) নিয়ে যাওয়া হয়েছে সব রোগীকে।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরও দুই শিশুকে খুঁজে পাননি পরিবারের সদস্যরা। নাজিয়া ও নাফির খালা তানজিনা আখতার বলছিলেন, নাজিয়াকে দেখেও শুরুতে চিনতে পারেননি তিনি।
তিনি বলেন, আমরা তার পাশ দিয়েই গেছি। তাকে দেখেও চিনতে পারি নাই। ডাক্তারকে বলেছি এটা আমাদের বাচ্চা না।
এর কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকরা যখন রোগীদের প্রাথমিক ড্রেসিং করাচ্ছিলেন, তখন নাজিয়া তার খালাকে দেখে চিনতে পারে, খালাকে হাত তুলে ডাকে। সে সময় সে বারবার তার ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিল। নাজিয়াকে বলা হয় তার ছোট ভাই সুস্থ আছে। ততক্ষণে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নাফিকেও খুঁজে পেয়েছে তার পরিবার।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে এক পর্যায়ে নাজিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সে সময় হাসপাতালে ছিলেন নাজিয়ার খালাতো ভাই লাবিদ। তিনি বলছিলেন, বাইরে থেকে দেখতে পাই যে ও (নাজিয়া) হাত-পা নাড়াচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল যে ওর কষ্ট হচ্ছে অনেক। তখন ডাক্তাররা এসে আমাদের বলে যে দোয়া করেন যেন বাচ্চাটা তাড়াতাড়ি মারা যায়, এত যন্ত্রণা ও নিতে পারছে না।
সোমবার ভোর রাত ৩টার দিকে মারা যায় ১২ বছর বয়সী নাজিয়া। মঙ্গলবার দুপুরে রাজাবাড়ী দক্ষিণপাড়া মসজিদে জানাজার পর পাশের গোরস্তানে দাফন করা হয় তাকে।
নাজিয়ার বাবা আশরাফুল ইসলামকে সেদিন আরেকবার দুঃসহ কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। একমাত্র মেয়ে হারানোর পর দিন পার না হতেই খবর পান ছেলের মৃত্যুর। নাফির শরীরে পুড়ে যাওয়ার মাত্রা তুলনামূলক বেশি থাকলেও তার পরিস্থিতি নাজিয়ার চেয়ে কিছুটা কম আশঙ্কাজনক ছিল। চিকিৎসকরা কিছুটা আশাও দিয়েছিলেন যে তাকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি ছোট্ট নাফি।
কথায় বলে–বাবার কাঁধে সন্তানের মৃতদেহ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। আশরাফুল ইসলামকে এই ভার টানতে হয়েছে দুইবার। সন্তানশোকে দিশাহারা পিতা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তাকে দুই দিক দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। নাজিয়া শেষ মুহূর্তে যে ভাইয়ের খোঁজ করছিল, মৃত্যুর পর রাজাবাড়ী দক্ষিণপাড়া কবরস্থানে তার কবরের পাশেই জায়গা হয়েছে তার ছোট ভাই নাফির।
Leave a Reply