free tracking

৯ বছরের সাদের খোঁজ পেয়েছেন বাবা!

রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত আরেক শিশুর নাম সাদ সালাহ উদ্দিন (৯)। মর্গে সাদের হাতে পরা লাল রঙের ঘড়ি দেখে বাবা সালাহ উদ্দিন মুকুল নিশ্চিত হয়েছিলেন, এটিই তার সন্তান। সাদ মাইলস্টোন স্কুলের বাংলা মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। বিমানটি সাদদের শ্রেণিকক্ষের ওপর আছড়ে পড়েছিল।

বুধবার (২৩ জুলাই) বেলা পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর দিয়াবাড়িতে সাদদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় শোকাবহ পরিবেশ। আত্মীয়স্বজন এসেছেন। সাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে ওমানপ্রবাসী বড় চাচা আলাউদ্দিন টুটুল সপরিবার দেশে এসেছেন। ছোট চাচা মোহাম্মদ মাসুদ আজ বৃহস্পতিবার আসবেন অস্ট্রেলিয়া থেকে। বসার কক্ষে গভীর বিষাদ নিয়ে বসে ছিলেন বাবা সালাহউদ্দিন মুকুল। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। আরেক কক্ষে মা খুকুমণি আক্তার স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় থেকে থেকে কেঁদে উঠছিলেন। কান্না ছাড়া তার মুখে কোনো ভাষা ছিল না। সাদ ছিল এই দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে বড়। সাদের ছোট বোন সারার বয়স দুই বছর। কক্ষের বিছানার পাশে সাদের পড়ার টেবিলে বই খাতা গোছানো। লাল রঙের ঘড়ির মতো নীল রঙের আরেকটি ঘড়ি ছিল টেবিলের তাকে। সেটিও সাদেরই। দাদি বিউটি আক্তার সাদের পোশাক দেখিয়ে আহাজারি করছিলেন। দুষ্টুমির কারণে মা–বাবা বকা দিলে সাদের আশ্রয়স্থল ছিল দাদি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ছেলেরা বিদেশ থেকে ফোন দেওয়ার পর বুঝতে পারি ভয়ংকর কিছু ঘটছে। পরে টিভি খুলে দেখি, কিয়ামত হয়ে গেছে।’

সাদের দাদা ও নানাবাড়ি মুন্সিগঞ্জে। দিয়াবাড়িতে পরিবারটি ভাড়া বাসায় থাকে।সাদের শোকার্ত মা–বাবাকে সন্তান নিয়ে প্রশ্ন করতে মানা করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। সাদের বাবা নিজ থেকে কথা বলার আগপর্যন্ত কথা হয় স্বজনদের সঙ্গেই। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার চার ঘণ্টার বেশি সময় পর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে গিয়ে সাদের মরদেহের খোঁজ পাওয়া যায়। এর আগে কয়েকটি হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। ওই সময় সাদের মা–বাবার সঙ্গে ছিলেন একমাত্র ফুফা আবু সাঈদ মিলন।

আবু সাঈদ বলেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়ে সাদের বাবা অফিস থেকে ও মা বাসা থেকে স্কুলে ছুটে যান। পরে তিনি সাদের মা–বাবার সঙ্গে যোগ দেন। স্কুলে গিয়ে সাদের খোঁজ পাননি। কেউ একজন বললেন, দগ্ধ অনেক শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে। এরপর তারা উত্তরার তিনটি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি রোগীদের মধ্যে খোঁজ করেন, মর্গেও খোঁজ করেন। কোথাও সাদ নেই। স্বজনদের আরেক দল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ করে পাননি। সব শেষে তারা সিএমএইচে গিয়ে চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে খোঁজ করেন, সেখানেও সাদ নেই। সাদের খোঁজে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন তারা। ওই সময় সাদের খোঁজ পাওয়া গেছে—এমন ভুয়া তথ্য দিয়ে কিছু ভুয়া কল এসেছিল, যা তাদের আরও বিষাদে ডুবিয়েছে।

আবু সাঈদ বলেন, সাদের বাবার অফিসের বস তার ব্যক্তিগত গাড়িটি সাদকে খোঁজার জন্য দিয়েছিলেন। সেটিতে চড়ে তারা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছিলেন। সিএমএইচে রোগীদের মধ্যে না পেয়ে সাদের মা–বাবাকে গাড়িতে রেখে তিনি সাদের ছবি নিয়ে মর্গে যান। সেখানে তাকে জানানো হয়, তিনটা লাশ রয়েছে। তবে তিনি শিশুর ফুফা জানার পর মর্গের দায়িত্বরত ব্যক্তি বলেন, একমাত্র মা–বাবা ছাড়া কারও লাশ শনাক্ত করার অনুমতি নেই। বাধ্য হয়ে তিনি গাড়ির কাছে ফিরে এসে সাদের বিপর্যস্ত বাবাকে নিয়ে মর্গে যান। মর্গ থেকে ছেলের পরনে কী কী ছিল, তার বর্ণনা চাওয়া হয়। তিনি বর্ণনা দেন। সে বর্ণনা মিলে যাওয়ায় তাকে লাশ দেখানো হয়। হাতে লাল রঙের ঘড়ি আর পরনে নেভি ব্লু আন্ডারপ্যান্ট ছিল সাদের। সেটি দেখার পর বাবা নিশ্চিত হন, এটি সাদ-ই।

আবু সাঈদ মিলন বলেন, সাদের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল, পেটের কাছে শার্ট পুড়ে গিয়েছিল, দুই হাতের কিছুটা ও চুল পুড়ে গিয়েছিল। তবে তার ঘড়ি, প্যান্ট, মোজা মোটামুটি ঠিক ছিল। তিনি জানান, মর্গে ছেলের লাশ পাওয়া গেছে জানার পর সাদের মা–বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। মা সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারান।

সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তর করে রাত ১০টার দিকে। রাত ১১টার দিকে বাসার নিচে জানাজা শেষে সাদকে সমাহিত করা হয় মিরপুর সাড়ে ১০ নম্বরে অবস্থিত কবরস্থানে। সেখানে সাদের দাদাও সমাহিত হয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *