আগামী ২ আগস্ট ২০২৭, দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলের আকাশ অন্ধকার হয়ে আসবে, যখন চাঁদ সরাসরি সূর্যের সামনে চলে আসবে। এই পূর্ণ সূর্যগ্রহণ কিছু কিছু স্থানে টানা ৬ মিনিট ২৩ সেকেন্ড স্থায়ী হবে, যা ১৯৯১ থেকে ২১১৪ সালের মধ্যে স্থলভাগ থেকে দেখা যাওয়া দীর্ঘতম সূর্যগ্রহণ।
এটি কেবল আরেকটি সাধারণ গ্রহণ নয়। Space.com জানিয়েছে, “এটি অতিশয়তা মনে হলেও, ২০২৭ সালের ২ আগস্টের পূর্ণ সূর্যগ্রহণকে ‘শতকের গ্রহণ’ বলা হচ্ছে যথার্থ কারণেই।”
এই গ্রহণের পূর্ণতার পথ (Path of Totality) — অর্থাৎ সেই সরু অঞ্চল যেখানে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাবে — তা জনবহুল এলাকাগুলোর ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে, ফলে এই দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা এবং আগ্রহ অনেক বেড়ে যাবে।

Space.com আরও লিখেছে, “এই আগস্টে পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যাবে না। তবে যদি শতকের দীর্ঘতম পূর্ণ সূর্যগ্রহণ আপনাকে টানে, তাহলে ২ আগস্ট ২০২৭ তারিখটি ক্যালেন্ডারে টুকে রাখুন এবং এখনই সফরের পরিকল্পনা করুন।”
এত দীর্ঘ গ্রহণের কারণ কী?
এই সূর্যগ্রহণটি সাধারণের তুলনায় অনেক দীর্ঘ হবে দুইটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনার কারণে—
- ওই দিন চাঁদ থাকবে তার কক্ষপথের পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে অবস্থান, অর্থাৎ ‘পেরিজি’-তে, ফলে এটি আকাশে তুলনামূলক বড় দেখাবে।
- একই সময়ে, পৃথিবী থাকবে তার কক্ষপথের সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরের স্থানে, অর্থাৎ ‘অ্যাফেলিয়ন’-এ, ফলে সূর্য ছোট দেখাবে।
এই নিখুঁত সমন্বয় চাঁদকে সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে রাখার সুযোগ করে দেয় দীর্ঘ সময়ের জন্য। এছাড়া, এই গ্রহণটি হবে বিষুবরেখার কাছাকাছি, যেখানে চাঁদের ছায়া তুলনামূলক ধীরে চলে যায়, যা গ্রহণের সময় আরও দীর্ঘ করে তোলে।

কোথায় দেখা যাবে সূর্যগ্রহণ ২০২৭
এই গ্রহণের পূর্ণতার পথ অতিক্রম করবে নিচের ১১টি দেশের উপর দিয়ে:
- দক্ষিণ স্পেন (বিশেষ করে কাদিস ও তারিফা শহর)
- জিব্রাল্টার
- মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, মিশর
- সুদান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, ওমান ও সোমালিয়া
মিশরের লাক্সর শহরে সবচেয়ে দীর্ঘ পূর্ণ গ্রহণ দেখা যাবে— ৬ মিনিট ২৩ সেকেন্ড পর্যন্ত।
এই পথের বাইরে থাকা অঞ্চলগুলো — যেমন ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া — আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখতে পাবে।
এছাড়া, ভারতের কিছু অংশ থেকে শুধুমাত্র আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। বিশেষ করে রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও গোয়া রাজ্যগুলোতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সূর্য ঢাকা পড়বে।
ভারতে সূর্যগ্রহণটি সম্ভবত বিকেল ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে ঘটবে (ভারতীয় সময়)। কিছু উপকূলীয় শহর — যেমন মুম্বাই ও গোয়া — সেখানে সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময় গ্রহণ হবে, ফলে দৃশ্যমানতা কিছুটা সীমিত হতে পারে।
ভারত পুরোপুরি পূর্ণতার পথে না থাকায়, পুরো গ্রহণ জুড়ে সুরক্ষিত গ্রহণ চশমা পরা বাধ্যতামূলক।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO), বিজ্ঞান প্রসার এবং প্ল্যানেটারি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া এই উপলক্ষে পাবলিক পর্যবেক্ষণ ও সরাসরি সম্প্রচারের আয়োজন করতে পারে।
বিজ্ঞানীদের জন্য এক বিরল সুযোগ
এই দীর্ঘ গ্রহণ বিজ্ঞানীদের জন্য এক মহামূল্যবান সুযোগ। দীর্ঘ সময় ধরে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা থাকায় তারা পারবেন:
- সূর্যের বাইরের স্তর করোনা-কে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে
- সূর্যের ফ্লেয়ার ও করোনাল মাস ইজেকশন পর্যবেক্ষণ করতে
- স্পেকট্রোস্কোপি ব্যবহার করে সূর্যের গঠন বিশ্লেষণ করতে
- গ্রহণকালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ও চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন নিরীক্ষণ করতে
- পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশে পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে
এই গবেষণা ভবিষ্যতের নাসার Parker Solar Probe এবং ESA-এর Solar Orbiter মিশনের জন্য তথ্য সংগ্রহে সহায়ক হবে।
সতর্কতা: চোখের সুরক্ষা জরুরি
ভারতসহ যেসব স্থানে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে, সেখানে চোখের সুরক্ষা ছাড়া সূর্যের দিকে তাকানো বিপজ্জনক।
ISRO অনুমোদিত অথবা ISO-সার্টিফায়েড গ্রহণ চশমা ব্যবহার করতেই হবে।
সাধারণ সানগ্লাস, মোবাইল ফোনের ক্যামেরা, কিংবা ফিল্টারবিহীন টেলিস্কোপ ব্যবহার করলে চোখের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
পূর্ণ গ্রহণের অঞ্চলগুলোতে কেবলমাত্র যখন সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে, তখন কিছু সময়ের জন্য চশমা খুলে সরাসরি দেখা যেতে পারে। কিন্তু একফোঁটা সূর্যের আলো দেখা গেলেই চশমা পুনরায় পরা বাধ্যতামূলক।
ভারতে সূর্যগ্রহণের সময় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রথা প্রচলিত। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, রাহু ও কেতু নামক ছায়াগ্রহ সূর্যকে “গিলে ফেলে” সূর্যগ্রহণ সৃষ্টি করে।
এই সময়ে অনেক মন্দির বন্ধ থাকে, মানুষ উপবাস পালন করে এবং নদীতে স্নান করে শুদ্ধতা রক্ষার জন্য।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈজ্ঞানিক সচেতনতা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম এই ধরনের ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এনেছে। এখন অনেকেই গ্রহণকে একটি প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ঘটনা হিসেবে দেখে, ভয় নয়, কৌতূহল ও নিরাপত্তার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে।
চাঁদ সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ ছোট, কিন্তু একইসাথে এটি পৃথিবীর চেয়ে সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ নিকটে, ফলে তারা আকাশে প্রায় একই আকৃতির দেখা যায়।
যখন তারা নিখুঁতভাবে একে অপরের সাথে সমরেখ হয়ে যায়, তখনই ঘটে এই দিনের বেলায় অন্ধকার নামা। তবে এই বিরল দৃশ্য কেবল দেখা যাবে সুনির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলে।
বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলের জন্য, ওই দিনটি অন্য যেকোনো দিনের মতোই কাটবে। কিন্তু যারা পূর্ণ গ্রহণের পথে থাকবেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে জীবনে একবারের দেখা পাওয়া এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
Leave a Reply