২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এক বছর কেটে গেলেও বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ধারা অব্যাহত৷ কেন এতদিনেও উন্নতি নেই এবং কী কী করলে নির্বাচনের আগে প্রত্যাশিত পরিবর্তন সম্ভব?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিকার অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভেবে কাজ করে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। — ডয়েচেভেলে
তারা মনে করেন, সরকার শুরুতে কঠোর না হয়ে ঢিলেমি করেছে, তাই এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
“আমরা যখন পুলিশ সংস্কার নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন দেখতে পাই, পুলিশের মনোবল ৪০ শতাংশে নেমে গেছে। পুলিশের এসপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে বুঝতে পারি, তারা ডিমরালাইজড হয়ে গেছেন। সেটা ছিল পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য নাসির উদ্দিন এলান এভাবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ডয়চে ভেলেকে জানিয়ে বলেন, “আসলে সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সময় লাগে। একটি বিপ্লব পরবর্তী দেশে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়। আমরা যে সুপারিশগুলো করেছি, তা বাস্তবায়ন করতে কিন্তু সংবিধান পরিবর্তনের দরকার নেই। ইচ্ছে করলে অধ্যাদেশ জারি করেই করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যপক ড. মো. তৌহিদুল হক মনে করেন, “৫ আগস্টের পর পুলিশের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। তাদের একটি অংশ আসামি হয়ে গেছে। আর নতুন করে তাদের মধ্যে নানা ধরনের চাপ, যা প্রধানত রাজনৈতিক , তা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধান্বিত করে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খানের কথা, “শুরু থেকেই পরিস্কার কোনো ম্যাসেজ ছিল না। সরকার যখন ব্যবস্থা না নিয়ে নিন্দা জানায়, তখন তো পরিস্থিতি খারাপ হবেই।
কেন এই অবস্থা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েকটি বিষয় গত এক বছরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, মব ভায়োলেন্স কঠোর হস্তে দমন না করা। মবকে সরকারের দিক থেকে কেউ কেউ ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলায় তারা আরো বেপরোয়া হয়েছে।
এছাড়া পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ভুয়া ও মিথ্যা মামলা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। ৫ আগস্টের আগে-পরে পুলিশের যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তার বড় একটি অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। অপরাধী গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়নি। পুলিশের মধ্যেও দক্ষতার অভাব দেখা দেয়।
পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “যে পরিস্থিতি, তা নিয়ন্ত্রণে তো আইন আছে। আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হবে তা-ও বলা আছে। এখন যদি সেটা ঠিকমতো প্রয়োগ না হয়, তাহলে কী করার আছে? এটা তো শুধু পুলিশকে দায় দিয়ে লাভ হবে না। বিষয়টি সার্বিকভাবে দেখতে হবে। সব যদি ঢিলেঢালা হয়ে যায়, তাহলে তো আর হবে না।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্ভব : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১১ আগস্ট দাবি করেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তিনি আরো দাবি করেন- এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্ভব। তার আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন। এরকম মন্তব্য অবশ্য তিনি আরো করেছেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারা কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা-সংঘর্ষের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে আসলে কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না।
৫ আগস্টের পর মাজারে হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মবের নামে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা, চুরি, ডাকাতি আর বিভিন্ন মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়, মামলা হয়ে যায় চাঁদা আদায়ের হাতিয়ার।
গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব সুফি সংস্থা অভিযোগ করে, তার আগের ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০টির বেশি মাজার শরিফ ও দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তারপরও এই হামলা থামেনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই – এই সাত মাসে সারা দেশে মব ভায়োলেন্স বা গণপিটুনির শিকার হয়ে ১০৩ জন নিহত হয়েছেন। ঢাকা বিভাগেই সর্বোচ্চ ৫১ জন নিহত হয়েছেন। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯২টি। রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে ২৮৮টি। এতে মারা গেছেন ৭৩ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে এক হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন এবং এর মধ্যে জুন মাসে দেশে সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন। এ সময়কালে সারা দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি। আর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজার ৮টি।
ডিএমপির হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসে ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ৩৩টি ডাকাতি, ২৪৮টি ছিনতাই, ১২১টি খুন এবং এক হাজার ৬৮টি চুরির মামলা হয়েছে। এ হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ২০টির বেশি খুন, পাঁচটি ডাকাতি ও ৪১টি ছিনতাই মামলা রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া মাসে ৭০টি চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে।
দেশে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ও স্থাপনাও ভাঙচুর এবং হামলার শিকার হচ্ছে। ঢাকায় জুন মাসে চারটি প্রাচীন স্থাপনা ভাঙা হয়। গত বছরের ১১ আগস্ট মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছয় শতাধিক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টির মধ্যে ৪৬০ থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ ধরনের প্রায় ছয় হাজার অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। এখন পর্যন্ত লুট হওয়া চার হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি এক হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টির মধ্যে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ নিজেও মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩, জানুয়ারিতে ৩৮ এবং ফেব্রুয়রিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটে।
যা করতে পারতো সরকার
পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বেশ হতাশার সুরে বলেন,” অনেক দিন ধরেই তো বলছি । কিন্তু পরিস্থিতির তো উন্নতি দেখছি না। নতুন নতুন সংকট হচ্ছে। আসল কথা হলো, আপনি পুলিশকে কাজ করতে দিচ্ছেন কিনা, তাকে চাপমুক্ত রেখে অপরাধ দমন করতে দিচ্ছেন কিনা। এটা পুলিশের একার বিষয় নয়।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “সরকার শুরুতেই যদি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে শক্ত অবস্থানে যেতো, তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
আর আইন প্রয়োগে দরকার ছিল নিরপেক্ষতা। কিন্তু দেখা গেছে, সরকার কোখাও কঠোর, কোথাও নরম। এর ফলে একটা মেসেজ চলে গেছে পুলিশের কাছে। তারা বুঝতে পেরেছে, সরকার কোথায় গরম আর কোথায় নরম।
তার কথা, “যেসব মব হয়েছে তার বিচার হয়নি। অপরাধীরা আটক হয়নি৷ ফলে অপরাধীরা আরো উৎসাহিত হয়েছে। সরকারের কাজ নিন্দা বা প্রতিবাদ জানানো নয়, সরকারের কাজ ব্যবস্থা নেয়া। সরকার যখন শুধু নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়, তখন বোঝা যায়, সরকারের কী অবস্থা বা সরকার কী করছে।
এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখছি না। একটা নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছে। অপরাধের বিরুদ্ধে যদি দল, মত নির্বিশেষে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে,” বলেন তিনি।
আর অধ্যপক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, “আসলে আইনের শাসন ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। যারা অভিযুক্ত, অপরাধী, তাদের কোনোভাবেই উৎসাহিত করা যাবে না, ছাড় দেয়া যাবে না। কোনো বিবেচনায় অপরাধীর অপরাধ হালকা করে দেখা যাবে না।
তার কথা, “পুলিশকে তার পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে দিতে হবে। পুলিশ তো এখন কে ক্ষমতায়, কে ক্ষমতায় আসবে সেই দিকে তাকিয়ে কাজ করে। সে তো ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়।
আর পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য নাসির উদ্দিন এলান মনে করেন, “ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে। তবে আরো দ্রুত নিয়ন্ত্রনে আনতে হলে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে।
Leave a Reply