বহমান জীবনে সমাজের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মানুষ কখন যে যন্ত্র হয়ে উঠেছে, তার খবর রাখেন না কেউই। শহর থেকে গ্রাম, সব জায়গায় যেন ইঁদুরদৌড়। এই ছুটে চলার মধ্যে যে শরীর একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাকানোর সময় নেই। আর এই অসচেতনতার সুযোগেই ধমনীর অন্দরে বাসা বাঁধে নীরব ঘাতক—করোনারি আর্টারি ডিজিজ।
অনেকেরই গোপনে হৃৎপিণ্ডের রক্তবাহী নালীর দেওয়ালে জমতে থাকে চর্বির আস্তরণ। শরীর কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে এই সংকেত দেয় না, বরং তার অনেক আগে থেকেই পাঠাতে থাকে ছোট ছোট সংকেত। আর সেই ছোট সংকেত চিনে নিতে পারার ওপরেই নির্ভর করে বহু মানুষের জীবন-মরণ।
হৃৎপিণ্ডের ধমনী সংকীর্ণ হয়ে এলে হৃদপেশিগুলোতে রক্ত ও অক্সিজেনের জোগান কমে যায়।
এই ঘাটতিই একাধিক উপসর্গের জন্ম দেয়, যেগুলোকে চিনে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
কোন লক্ষণগুলো অবহেলা করা অনুচিত
বুকের যন্ত্রণা বা অ্যাঞ্জাইনা : হৃদরোগের সবচেয়ে পরিচিত উপসর্গ এটি। তবে এই যন্ত্রণা ছুরির ফলার মতো ধারালো হয় না। বরং বুকের গভীরে এক ধরনের দমবন্ধ করা চাপ, পেষণকারী অনুভূতি বা ভারী বোঝা চেপে বসার মতো অস্বস্তি হয়।
এই যন্ত্রণা প্রায়শই বুকের মাঝখান থেকে বাঁ কাঁধ, বাহু, ঘাড় বা চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এই সমস্যাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম, যেমন দ্রুত হাঁটা বা সিঁড়ি ভাঙার সময় শুরু হয় এবং বিশ্রামে থাকলে ধীরে ধীরে কমে আসে। শ্রমের সঙ্গে আগমন, বিশ্রামে অন্তর্ধান- এই সমীকরণটিই হৃদরোগের ব্যথার অন্যতম বড় সূচক।
শ্বাসকষ্ট : মাসকয়েক আগে আপনি যে সিঁড়ি অবলীলায় ভাঙতেন, সেখানে বর্তমানে মাঝপথেই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। সামান্য পরিশ্রমে দম ফুরিয়ে আসা বা হাঁপ ধরা ধমনী ব্লকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়লে তা দক্ষতার সঙ্গে রক্ত পাম্প করতে পারে না, যার ফলে ফুসফুসে চাপ পড়ে এবং শ্বাসকষ্ট হয়।
অকল্পনীয় ক্লান্তি : সারা দিনের কাজের শেষে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্লান্তি সে রকম নয়। ঘুম থেকে ওঠার পরেও যদি শরীরজুড়ে তীব্র অবসাদ থাকে, যদি দৈনন্দিন কাজ করতেও অনীহা বা অক্ষমতা বোধ হয়, তবে তা চিন্তার বিষয়। এটি জানান দেয়, সংকীর্ণ ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত পাঠাতে হৃৎপিণ্ডকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তাই সে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।
ছদ্মবেশী উপসর্গ : অনেক সময়, বিশেষত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী ও নারীদের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথার মতো চিরাচরিত লক্ষণ দেখা যায় না। তার পরিবর্তে বুকজ্বালা, হজমের গোলমাল, বমি ভাব, মাথা ঘোরা বা ঠাণ্ডা ঘামে শরীর ভিজে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। গ্যাস-অম্বলের সমস্যা ভেবে এই লক্ষণগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া এক মারাত্মক ভুল হতে পারে।
শরীর যখন অসুস্থতার কথা জানান দেয়, তখন সেই কথা শুনতে শিখুন। ওপরের উপসর্গগুলো যদি আপনার জীবনেও হানা দিয়ে থাকে, তবে তাকে বয়সের দোহাই দিয়ে বা কাজের চাপ আছে বলে এড়িয়ে যাবেন না। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।
মনে রাখবেন, ধমনীর অসুখের ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। আপনার আজকের সচেতনতাই আগামীর বড় বিপদকে রুখে দিতে পারে।
Leave a Reply