শেখ হাসিনার পতনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত!

গণ আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। পরে ছোটবোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। শেখ হাসিনা সরকারে অথবা বিরোধীদলে থাকুক ভারত সব সময় তার সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব দেখিয়ে পাশে থেকেছে। সেটি সেই ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে নরেন্দ্র মোদির আমলেও। তবে এবার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত চলে যাওয়ায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দিল্লি। এর আগে বাংলাদেশকে নিয়ে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে কখনোই পড়তে হয়নি ভারতকে।

এছাড়া শেখ হাসিনার পতনে ভারত এতটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক একটি বিবৃতি দিতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়েছে দিল্লি।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দিল্লিতে একাধিক পর্যবেক্ষক জানিয়েছে- সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি ভারত সরকারকে একটা ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু সিচুয়েশন’ বা চরম উভয় সংকটে ফেলে দিয়েছে। আর এই বিপদটা আসছে দু’দিক থেকে। এক- ব্যক্তি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে দিল্লি কী পদক্ষেপ নেবে আর দুই- বাংলাদেশের ভেতরে যা ঘটছে সেটাকেই বা দিল্লি কীভাবে অ্যাড্রেস করবে।

যেমন শেখ হাসিনাকে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়াটা ভারতের উচিত হবে কি না, তা নিয়েও ভারতে দুরকম মতামত শোনা যাচ্ছে। অনেকেই এর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, আবার এর বিপক্ষেও মত দিচ্ছেন কেউ কেউ।

এদিকে বাংলাদেশের ভেতরের বর্তমান যে পরিস্থিতি সেখানে দিল্লির কী করণীয় আছে তা নিয়েও পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে স্পষ্ট দ্বিমত আছে।

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশে ছাড়ছেন বিষয়টি শুনে দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো তথা বাংলাদেশ গবেষক ম্ম্রুতি পট্টনায়ক বলেন, শেখ হাসিনা যেখানে খুশি যান, ভারতে না-এলেই হল!

তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি শেখ হাসিনা যদি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, তাহলেও ভারতের উচিত হবে না সেটা মঞ্জুর করা। কারণ বাংলাদেশে সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন হয়েছে তার একটা স্পষ্ট মাত্রা ছিল ভারত বিরোধিতা।

স্ম্রুতি পট্টনায়ক বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে দেখা হত ভারতকে। তাই হাসিনা বিরোধিতার আন্দোলনে স্বভাবতই মিশে ছিল ভারতবিরোধিতার উপাদান। এই পটভূমিতে ভারত যদি তাকে এখন রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, সেটা একটা ভুল বার্তা দেবে এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারত বিরোধিতাকে আরও উসকে দেবে।

ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ১৯৭৫-এ যে পটভূমিতে শেখ হাসিনাকে ইন্দিরা গান্ধী সরকার ভারতে আশ্রয় দিয়েছিল তার চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। তখন যেটা সম্ভব ছিল, এখন সেটা সম্ভব নয়। সে সময়কার মতো শেখ হাসিনাকে তো আর পান্ডারা রোডের একটা ফ্ল্যাটে কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই রাখা যাবে না, এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা তসলিমা নাসরিনও নন যে দিল্লি পুলিশের পাহারায় শহরের কোনও ফ্ল্যাটে তাকে রাখা যাবে। আর এই সিদ্ধান্তের ‘জিওপলিটিক্যাল রিস্ক’-টাও অনেক বেশি, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।

এদিকে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন ভিন্ন কথা। তার মতে, শেখ হাসিনা যদি কোনো কারণে ভারতে থাকতে চান, তার মর্যাদা ও সম্মান অনুযায়ী যথাযথ পর্যায়ে (অ্যাপ্রোপ্রিয়েট লেভেল) তার সঙ্গে এনগেজ করতে হবে। এখানে দ্বিতীয় কোনো ভাবনার অবকাশ নেই।

তিনি বলেন, পুরনো ইতিহাস ও এতদিনের সম্পর্ককে মাথায় রেখে তার ইচ্ছাকে ভারতের সম্মান দিতে হবে।

এছাড়া বিজেপির ঘনিষ্ঠ ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ শুভ্রকমল দত্ত মনে করেন, এখনই স্থায়ীভাবে না-হলেও শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। যতদিন না তৃতীয় কোনও দেশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে তিনি আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত ভারতের উচিত হবে তাকে সসম্মানের সাথে ভারতেই রাখা।

এদিকে বাংলাদেশে বিশেষ করে গত ৪৯ ঘণ্টায় যে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যে ধরনের অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বা সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন তাতে ভারতের এখন ঠিক কী করা উচিত তা নিয়ে দেশের ভেতরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, বাংলাদেশে ভারত একটি শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও স্থিতিশীল সরকার চায়, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। আর কোনো দেশই চায় না তার ঘরের পাশে একটি শত্রুভাবাপূর্ণ সরকার থাকুক। সুতরাং বাংলাদেশে পরবর্তী সরকার যাতে ভারতের প্রতি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ থাকে, তার জন্য যা যা করা উচিত সেটা করা দরকার।

কংগ্রেস নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুরও বলেন, জামায়াতের যে ভারত-বিরোধিতার ইতিহাস, তাতে নতুন সরকারে তাদের প্রভাব কতটা হবে সে ব্যাপারে ভারতকে আগেভাগেই সতর্ক থাকতে হবে। এমনকি, ওই সরকারের ওপর চীন বা পাকিস্তানের মতো শক্তিগুলো কলকাঠি নাড়াতে চাইবে।

এদিকে জামায়াতের তথাকথিত প্রভাব ঠেকানোর জন্য ভারত ঠিক কী করতে পারে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট দিশা দেখাতে পারেননি তারা কেউই।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, আমার মতে প্রথমে কমিউনিকেশনের চ্যানেলগুলো খুলতে হবে। ওপেন আপ করতে হবে। বাংলাদেশে কারা এই মুহুর্তে শেষ কথা বলছেন বা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেটা আমরা জানি না। তাদেরকে ভাল করে চিনিও না। আমরা যদি তাদের সঙ্গে একটা সুস্থ ও স্বাভাবিক ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ চাই, তাহলে সবার আগে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

এদিকে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির ভেতর থেকেই কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ‘সফট ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাপ্রোচে’র বদলে ‘কঠোর দৃষ্টিভঙ্গী’ নেয়ার দাবি উঠছে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের ওপর এখনই চাপ প্রয়োগ করা দরকার। তা না হলে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক কোটি হিন্দু পালিয়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হবেন।

শুভ্রকমল দত্ত বলেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধও কিন্তু শুরু হয়েছিল শরণার্থী সমস্যা দিয়ে। আমি মনে করি বাংলাদেশের বর্তমান সংকটে ভারতের অনেক আগেই সরাসরি হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল, তখন সেটা না-হলেও এখন কিন্তু করতেই হবে।’

‘হস্তক্ষেপ’ মানে অবশ্য কেউ বাংলাদেশে সেনা পাঠানোর কথা বলছেন না, তবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের ওপর কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক যত ধরনের চাপ প্রয়োগ সম্ভব- সে দিকেই ইঙ্গিত করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *