শেখ হাসিনার পর কোন পথে বাংলাদেশ, যা ভাবছেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক!

যেকোন গণআন্দোলনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শুধুমাত্র শাসকের পরিবর্তন নয় বরং সংস্কারের ধারা এবং বিপ্লবের চেতনাকে টিকিয়ে রাখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন এবং ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতিসহ সাম্প্রতিক সহিংসতা অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।

দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাকে পদত্যাগ করার কথা বলার আগে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল, যার মধ্যে ৯০ জন নিহত হয়েছিল একদিন আগে। সেনাপ্রধান একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে এটি কতদিন স্থায়ী হবে এবং কখন একটি নতুন গণতান্ত্রিক পথে ফিরে আসবে দেশ তা স্পষ্ট নয়। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মাত্র এক মাস আগে সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ঐতিহাসিকভাবে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে ছাত্র অভ্যুত্থান প্রায়শই পরিবর্তনের দাবি নিয়ে সংঘঠিত হয়েছিল। শেখ হাসিনা, যিনি নিজেও আগে এ ধরনের আন্দোলনে সংক্রিয় ছিলেন, তার অন্তত এই ধরনের ছাত্র আন্দোলনের উত্তাপ বোঝা উচিত ছিল। ১৯৭৫ সালে তার বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পতন এবং শেষ পর্যন্ত নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকেও তার শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। এমনটি উঠে এসেছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাজহার আব্বাসের নিবন্ধে।

অন্য যেকোনো জাতীয় সমস্যার মতো ‘চাকরিতে কোটা পদ্ধতির’ বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন তিনি মোকাবিলা করতে পারতেন। কিন্তু এর পরিবর্তে এটিকে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে তকমা দিয়ে তিনি তার ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনেন।

বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইরান ও আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান পর্যন্ত এসব দেশে ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ইতিহাস গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি পাল্টে দিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লব তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয় এবং আফগানিস্তানের একই ধরনের পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পাকিস্তানের শাসনামলে ক্যাম্পাসভিত্তিক আন্দোলন, ১৯৫৩ সালের ছাত্র আন্দোলন এবং আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

শেখ হাসিনার বোঝা উচিত ছিল যে তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র আন্দোলনেরই ফসল। দুর্ভাগ্যবশত, বঙ্গবন্ধুকন্যা একজন স্বৈরশাসকের মতো আচরণ শুরু করেছিলেন এবং তার রাজনৈতিক বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেটা হোক সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপি বা শরিকদল জামায়াত-ই-ইসলামী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ধর্মভিত্তিক দলটিকে কয়েক মাস আগে নিষিদ্ধ করেছিলেন শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল তার শাসনামলে।

এই দিকে, দেশে গণতন্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আগে বাংলাদেশিরা কয়েকবার সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা পেয়েছিল। কিন্তু সংজ্ঞা অনুসারে গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের ইচ্ছা। জনগণের যদি ক্ষমতা থাকে আপনাকে শাসন ক্ষমতায় আনার, তবে আপনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সেই ক্ষমতাও আছে জনতার। সেটি হতে পারে নির্বাচনের মাধ্যমে অথবা রাস্তার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে।

প্রতিটি গণ-আন্দোলন জনসাধারণের সমস্যাগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এদের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা, চাকরির অভাব বা বিচারহীনতার রাজনীতি। সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে যে আন্দোলন উত্তাল হয়ে ওঠেছিল, সম্প্রতি শেখ হাসিনার নেয়া দমন নীতিতে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়। কারণ জনগণ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কোটার বিরোধিতা করেছিলের এবং আরও যথাযথ সংস্কার চেয়েছিলেন। তিনি একটি সাধারণ সমস্যা কঠোরভাবে দমন করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে ‘মুষ্টিমেয়’ বিরোধীদের এই আন্দোলন তিনি রুখে দিতে পারবেন। তিনি ভুল প্রমাণিত হন এবং পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তা বোঝার পরিবর্তে তিনি দমননীতি প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং ইন্টারনেট নিষিদ্ধ করা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া।

সেনাবাহিনী তাকে দেশছাড়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো যাতে করে ১৯৭৫ সালের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে না হয়। কিন্তু এখন তিনি দেশ ছেড়েছেন এবং নির্বাসনে চলে গেছেন। কত বছর তাকে এভাবে থাকতে হয় তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।

রাজনীতি হলো সুযোগকে কাজে লাগানোর খেলা এবং বাংলাদেশে এটি এখন নির্ভর করছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ও ভবিষ্যৎ সরকারের ওপর। অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসা আগামীর সরকারের উচিত হবে না শেখ হাসিনা বা তার দল আওয়ামী লীগের ভুলের পুনরাবৃত্তি করা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম এবং অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ‘চাকরির কোটা’-এর মূল সমস্যাটি সমাধান করা। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। নতুন শাসক অন্তর্বর্তীকালীন হোক বা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হোক, শেখ হাসিনার মতো রাজনৈতিক নিপীড়নের নীতি গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আরও বিশৃঙ্খল হতে পারে।

এ জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা দেখতে আর খানিকটা অপেক্ষা করতে হবে। এরপর জানা যাবে, নতুন নির্বাচনের আগে কত সময় বাকি রয়েছে। হতে পারে তিনি আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে অজনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। কিন্তু রাজনীতিতে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত গোটা দৃশ্যপট পাল্টে দিতে পারে, যা দেশের নতুন শাসকদের অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত।

সূত্র : জিও নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *