গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) ঢাকার সাইনবোর্ড এলাকার বাসা থেকে রাজ মিস্ত্রি কাজের উদ্দেশে বেড়িয়ে যান মো. ইয়াছিন (১৮)। নামাজের পর বাড়িতে মায়ের সাথে মুঠোফোনে কথাও হয় তার। মাকে বলেছিলেন, বিকেলে কাজ থেকে ফিরে মাকে বিকাশে টাকা পাঠাবেন। কিন্তু টাকার পরিবর্তে পরদিন মায়ের কাছে গেছে ছেলের লাশ।
ইয়াছিনের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বিকেলে বাসা থেকে কাজে গিয়ে রাতে বাসায় ফেরার পথে কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষ চলাকালে নিহত হন ইয়াসিন। বাসায় থাকা অন্য ভাইয়েরা তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার হদিস পাননি। পরদিন সকাল ৮টার দিকে ইয়াসিনের ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে বড় ভাই সোহাগের ফোনে কল করে অপরিচিত এক লোক জানান, ইয়াছিনের মরদেহ সড়কের পাশে পড়ে আছে। পাশে থাকা মোবাইল থেকে সিম খুলে অন্য মোবাইলে ঢুকিয়ে তিনি কল দিয়েছেন।
খবর পেয়ে বড় ভাই সোহাগ তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করেন।
মো. ইয়াছিন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মো. লালু মিয়ার ছেলে। পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ইয়াছিন ছিলেন চতুর্থ। ছোট বেলায় তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
কৃষক বাবার সংসারে অভাব অনটনের কারণে পড়ালেখা বাদ দিয়ে গত কয়েক বছর আগে কাজের উদ্দেশে ঢাকায় চলে যান। পাঁচ ভাই মিলে ঢাকার সাইনবোর্ড এলাকায় থেকে বিভিন্ন জায়গায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
নিহত ইয়াছিনের মেঝো ভাই মো. শিপন জানান, তাদের ঘর ভিটা ছাড়া আর কোনো যায়গা জমি নেই। তাই একে একে ঢাকায় পাড়ি জমান পাঁচ ভাই। অভাবের কারণে ভাইদের মধ্যে কেউ এসএসসির গণ্ডি পেরোতে পারেননি।
বড় ভাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করলেও বাকিরা সবাই ব্যাচেলর হিসেবে পাশাপাশি বাসায় ভাড়া থাকতেন। ছোট ভাই সাগর ও ইয়াছিন একই রুমে থাকতেন।
তিনি আরো জানান, ১৯ আগস্ট সকালে সবাই যার যার কাজে বেড়িয়ে পড়েন। ইয়াছিনের কাজ ছিল সাইনবোর্ডের কাছে ঝালকুড়ি এলাকায়। সকালে কাজে গিয়ে দুপুরে আবার বাসায় ফিরে আসেন। জুমার নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার চলে যান কাজে। রাতে আর বাসায় ফিরে আসেননি ইয়াছিন। সকাল বেলা তার ঘরে থাকা ছোট ভাই সাগর জানায়, ইয়াছিন রাতে বাসায় আসেননি। এ সময় তারা সবাই অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। শনিবার সকাল ৮-৯টার দিকে ইয়াছিনের মোবাইল থেকে কল করে অপরিচিত এক লোক জানান, ইয়াছিন মৃত অবস্থায় দেলপাড়া এলাকায় সড়কের পাশে পড়ে আছে। তিনি ইয়াছিনের সিমকার্ড তার মোবাইলে লাগিয়ে কল করেছেন। এ খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে ছুটে যান তারা। পরে সেখানে গিয়ে দেখেন ইয়াছিনের পুরো শরীর ঝলসে গেছে। চেনার মতো উপায় নেই। এ অবস্থায় স্থানীয় ফতুল্লা থানার ওসির সঙ্গে কথা বলে মরদেহ উদ্ধার করে শনিবার রাতে গ্রামের বাড়িতে এনে মসজিদের পাশে দাফন করেন তারা।
ইয়াছিনের বাবা লালু মিয়া জানান, তার সম্পদের মধ্যে পাঁচ ছেলেই ছিল। এরা কাজ করে যা দিত তা দিয়ে সংসার চলত। তিনি পরের জমি বর্গা চাষ করে কোনো মতে সংসার চালাতেন। গত কয়েক দিন আগে মায়ের কাছে দেড় হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। শুক্রবার মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও মা নিলুফা বেগমের সাথে কথা হয় ইয়াছিনের। মা বলেছিলেন ‘বাবা টাকা যা পাঠাইছো তা তো কিস্তি দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। টাকা নাই। তখন ছেলে বলেছিল, মা আমি আজকে কাজের টাকা পামু। টাকা পাইলে তোমার জন্য আরো ৫০০ টাকা পাঠামু।’ এই কথাই ছিল পরিবারের সাথে ইয়াছিনের শেষ কথা। আর কোনো কথা হয়নি। ছেলের হত্যার বিচার দাবি করেন ইয়াছিনের ষাটোর্ধ্ব বাবা লালু মিয়া।
Leave a Reply