বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। দেশের শেয়ারবাজার ও ব্যাংক খাতের কেলেঙ্কারি এবং কারসাজিতে মাফিয়া হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি। কারসাজির নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কারে তার জুড়ি মেলা কঠিন। ১৯৯৩ সাল থেকে শেয়ারবাজারের সব কেলেঙ্কারিতেই সম্পৃক্ত সালমান। তবু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে সবসময় রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০০৬ সালে এক ব্যক্তিকে ভুয়া সৌদি যুবরাজ সাজিয়ে রূপালী ব্যাংক কেনার নাটক সাজান সালমান এফ রহমান। এ প্রক্রিয়ায় রূপালী ব্যাংকের শেয়ার থেকে ৯০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে দৃশ্যমান ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড ছেড়ে নিয়েছেন ৩ হাজার কোটি, আইএফআইসি আমার বন্ড ছেড়ে ১ হাজার কোটি এবং ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ছেড়ে। এছাড়া অদৃশ্য ও বেনামি মিলিয়ে তিন বছরেই এ অংক ছাড়িয়ে যাবে ২০ হাজার কোটি টাকা।
১৯৯৬ সালে শাইনপুকুর সিরামিক ও দোহা সিকিউরিটিজের কেলেঙ্কারিতে জড়ান সালমান এফ রহমান। উচ্চ আদালতে চলমান ঐ সংক্রান্ত মামলায় এখনো আসামি তিনি। শেয়ারবাজার কারসাজি নিয়ে ২০১১ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্টেও তার নামে আসে। ঐ সময় প্রভাব খাটিয়ে বেক্সিমকো ফার্মার প্রেফারেন্স শেয়ার পাস করিয়ে নেন তিনি। এ শেয়ারের মাধ্যমে প্রিমিয়ামসহ ৪১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন।
একই সময়ে শাইনপুকুর সিরামিকের মাধ্যমে ২৮৬ কোটি এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলের মাধ্যমে ৬৩৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এছাড়া জিএমজি এয়ারলাইন্সের প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা নেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ঐ কোম্পানি উধাও হয়ে যায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আর টাকা ফেরত দেননি।
একইভাবে জিএমজি এয়ারলাইন্সের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ২২৮ কোটি ঋণ নেন সালমান এফ রহমান। এক্ষেত্রে জামানত হিসেবে তার ধানমন্ডির বাড়ি বন্ধক রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে টাকা শোধ না করলে তার বাড়ি নিলাম ডাকে সোনালী ব্যাংক। ২০১৩ সালে আইএফআইসি ব্যাংকের টাকায় নেপালের লোকসানি প্রতিষ্ঠানের ১০ টাকার শেয়ার ৭৫ টাকায় কেনেন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় সেখানে ১২৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়। ২০১১ সালে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে আইএফআইসি মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন।
২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সালমান এফ রহমান ঢাকা-১ আসন থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য হন। দুই নির্বাচনেই তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, সন্ত্রাস, সাংবাদিকদের ওপর হামলাসহ বহুবিধ নারকীয় কর্মকাণ্ডের উভিযোগ উঠেছিল। নবাবগঞ্জ-দোহার এলাকায় উন্নয়নের নামে সরকারি অর্থ লুটপাট করার অভিযোগও রয়েছে সালমানের বিরুদ্ধে।
ব্যাংক দখল, ঋণের নামে ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা লুটপাট, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ব্যাংক থেকে বেআইনি সুবিধা নেয়া, দেশ থেকে টাকা পাচার, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে সালমানের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ১৭ দফা খেলাপি ঋণ নবায়ন করার মতো গুরুতর আর্থিক অনিয়মও করেছেন তিনি। মন্ত্রিসভার সদস্য না হলেও সরকারের সব পর্যায়ে তার ছিল ব্যাপক প্রভাব। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন তিনি। আলোচ্য সময়ে ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা লুটপাট করেছেন। ২০০৯ সালের আগে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়।
নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। হিসাব অনুযায়ী, এর মাধ্যমে তারা শুধু একটি গ্রুপকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু কোনো একক গ্রাহককে মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) বেশি ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই।
একাধিকবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের সার্বিক ঋণের তথ্য চেয়ে চিঠি দিলেও তা পরিপালন করেনি ব্যাংকটি। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করা হয়েছে। এরপর নতুন করে আরো ৪৭৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ঋণের আবেদন করেছে বেক্সিমকো। কিন্তু এত বড় সিদ্ধান্ত ব্যাংকের পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে জনতা ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫ জুলাই জনতা ব্যাংকের ৭৭৮তম পর্ষদ সভায় বেক্সিমকো গ্রুপের ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় উল্লিখিত সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কোনো গ্রাহককে বিশেষভাবে একক গ্রাহক ঋণসীমা এবং ঋণ পুনঃতফশিলের সুবিধা দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতির বিধান রয়েছে। প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলেও জনতা ব্যাংককে এই ঋণের বিষয়ে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফশিল ও একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রমের দায় থেকে জনতা ব্যাংককে মুক্তি দিলেও দুটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে- ১. ব্যাংকে গ্রাহকের মোট ঋণের পরিমাণ আর বাড়ানো যাবে না। ২. ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে গ্রাহকের ঋণ সুবিধা ২৫ শতাংশ সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।
অন্যান্য ব্যাংক
সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের একটি ঋণ ১৭ দফা নবায়ন করা হয়েছে। এর আগে সিটি ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের নামে নেয়া ঋণ খেলাপি হয়েছিল। এবি ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপির দায়ে পরিচালক পদ ছাড়তে হয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপকে। সিটি ব্যাংক থেকে রপ্তানির নামে ঋণ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এক্সিম ব্যাংক থেকে বেনামে ঋণ নিয়ে তা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার মতো কেলেঙ্কারির ঘটনাও রয়েছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। সেসব ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।
দেশে করোনা মহামারির সময় টিকা নিয়ে জালিয়াতি করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনাও রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে। ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গঠিত দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের তদন্তে বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে বিদেশি কর্মী নিয়োগের নামে দেশ থেকে টাকা পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ঐ সময় সালমান এফ রহমানের নামে লন্ডনে ৩৫০ কোটি ডলারের একটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের সন্ধান পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে তিনি দেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন।
সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর প্রয়াত লুৎফর রহমান সরকারের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগও রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বেআইনিভাবে ঋণ আটকে দেওয়ায় তিনি গভর্নরের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন।
ব্যাংক খাতে ছিল সালমান এফ রহমানের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব। নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দিতে কোনো ব্যাংক ভিন্নমত পোষণ করতে পারেনি। ফলে বেআইনিভাবেই তাকে ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র্রযন্ত্রকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি। এতে ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশই চলে গেছে তার পকেটে।
Leave a Reply