কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই মাসে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের রাজপথ। বিক্ষোভ দমনে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ, বিজিবি, র্যাব। পরে দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউ জারি করে মাঠে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা যান কয়েকশ মানুষ।
এক পর্যায়ে ছাত্র বিক্ষোভ ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৭ জন উপদেষ্টা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহত এক ছাত্রের পিতা আবেদনের পর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটা হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ নয় জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)।
বুধবার (১৪ আগস্ট) করা ওই আবেদনের পরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ‘আইসিটিতে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হবে’ বলে জানান অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ”আইসিটিতে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হবে এটা ক্যাটাগরিক্যালি বলতে পারেন। এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আছে, এই বিচারের আওতায় আমাদের সাবেক সরকার প্রধানসহ অন্য যারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে- আমরা তাদের কোনো ছাড় দেবো না।”
এখন প্রশ্ন উঠছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য করা এই আইনে কি শেখ হাসিনার বিচার করা সম্ভব? আর আইনটিতেই বা কী বলা আছে?
মূলত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। তখন ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই অভিযুক্তদের তদন্ত এবং বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই এই আইনটি প্রণয়ন করা হলেও ২০১০ সালের আগে আইনে কারো বিচার বা সাজা হয়নি।
২০০৯ সালে সংসদ অধিবেশনে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার’ বিষয়ে একটি মৌখিক প্রস্তাবও পাশ হয়। পরবর্তীতে ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকেও বিচারের আওতায় আনা এবং স্বাধীনভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনার বিধান যুক্ত করে আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমেই ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।
১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের ৩(১) ধারায় বলা আছে, আইনের দুই নং উপধারায় উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী (বা সংস্থা) বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তার বিচারের এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকবে।
অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন বিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী সশস্ত্রবাহিনীর বিচারের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়েছে।
এই আইনের অধীনেই শেখ হাসিনার বিচার করা সম্ভব বলে জানান বাংলাদেশ সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, “১৯৭৩’র যে আইনটা আছে, ওখানে ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটির (মানবতাবিরোধী অপরাধ) সংজ্ঞা অনুসারে এটি অফেন্স (অপরাধ) হিসেবে আসে, অন্যগুলোর মধ্যে না”। অর্থাৎ, আইনের তিন নং ধারার ২(ক) উপধারায় উল্লিখিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা যেতে পারে।
এই ধারা অনুযায়ী, হত্যা, নির্মূল, দাসত্ব, নির্বাসন, কারাবরণ, অপহরণ, বন্দীকরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ বা কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অন্যান্য অমানবিক কাজ বা রাজনৈতিক, জাতিগত বা ধর্মীয় ভিত্তিতে নিপীড়নের মতো ক্ষেত্রগুলোতে এই ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রসিকিউটর হিসাবে কাজ করা ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ”এই আইনের একটা লম্বা প্রেক্ষাপট আছে। এটা করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। সেখানে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের বিচার করার জন্য এই আইনটি করা হয়।” ফলে এখন যে প্রেক্ষাপটে বিচারের কথা বলা হচ্ছে, তা প্রযোজ্য হয় না বলে তিনি মনে করেন।
তবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ মনে করেন, আইনে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচারে কোন বাধা নেই। তার কথায়, “যে আইনটা এর আগের সরকার সংশোধন করেছিল, সেখানে আইন যেভাবে আছে সেই বিবেচনায় ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটি বা জেনোসাইড- এসব বিষয় সেখানে বিচার করার সুযোগ আছে”।
এছাড়াও ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা এবং কোন কোন অপরাধে বিচার করা যাবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে আইনে বলা এবং ব্যাখ্যা দেয়া আছে বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী। সেক্ষেত্রে ‘এনিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই’ বলেই মত তার।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Leave a Reply