আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২তম নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তারা। দীর্ঘ ১৫ বছর পর অন্তর্বর্তী সরকারে আবার সেই ৮২’র নিয়মিত ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ফিরে এসেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত ৮২’র ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত পাঁচজন অতিরিক্ত সচিব গতকাল শনিবার সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা হলেন ড. শেখ আব্দুর রশিদ, মো. এহছানুল হক, ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন, ড. নাসিমুল গনি ও এম এ আকমল হোসেন আজাদ।
১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেখ আব্দুর রশিদ, এহছানুল হক, মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন, নাসিমুল গনি ও এম এ আকমল হোসেন আজাদ ২০০৯-১০ সালের মধ্যে সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাঁদের সচিব পদে পদোন্নতি না দিয়ে দীর্ঘদিন ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে রাখা হয়। এরপর শেখ আব্দুর রশিদ, নাসিমুল গনি ও এম এ আকমল হোসেন আজাদকে জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় আওয়ামী লীগ সরকার। আর এহছানুল হক ও মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন দীর্ঘদিন ওএসডি থেকে অবসরে যান।
অথচ শেখ আব্দুর রশিদ ৮২’র ব্যাচের মেধাতালিকায় প্রথম ছিলেন। মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদসচিব হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি সচিবও হতে পারেননি। শেখ আব্দুর রশিদকে চাকরিচ্যুত করতে বিভাগীয় মামলাও দেওয়া হয়েছিল।
সাবেক যুগ্ম সচিব মাহবুবুর রহমান ফারুকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শেখ আব্দুর রশিদের অভিযোগের বিষয়ে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। স্যারের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছিল। পিএসসির মতামত দিতে গিয়ে দেখা যায়, মামলাটিতে ১৩টি মিথ্যা অভিযোগ রয়েছে। পরে এগুলো স্পষ্ট করতে বলা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ৮২’র ব্যাচ
এই ব্যাচে মোট কর্মকর্তা ছিলেন ১৯১ জন।
এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সচিব সুরাইয়া বেগম এই ব্যাচের মেধাতালিকায় ১৭৮তম হওয়ার পরও তিনি জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। একই সঙ্গে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আইএমইডি, পরিসংখ্যান বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ চারটি মন্ত্রণালয়-বিভাগে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছিলেন। এরপর অবসরে গিয়ে তথ্য কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হলে সুরাইয়া বেগম সচিব হতে পারতেন না। শফিউল আলম রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের ও ভূমি সচিবের পর ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে চুক্তিতে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পান। হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (কর্মসূচি), তথ্য, সংস্কৃতি ও বিমানের সচিব ছিলেন।
আট বছরে ছয়টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। আবুল কালাম আজাদ বিদ্যুৎ, ইআরডি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও মুখ্য সচিব ছিলেন। পরে তাঁকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের পদ সৃষ্টি করা হয়। সর্বশেষ তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী তথ্য, শিক্ষা, জনপ্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন।
মোজাম্মেল হক খান সড়ক ও রেলওয়ে, স্বরাষ্ট্র এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। অবসরে যাওয়ার আগে পাঁচ বছরের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার করা হয়।
তাঁরা সবাই ছিলেন ৮২’র ব্যাচের কর্মকর্তা এবং সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সদস্য। ফলে অলিখিত অনেক নিয়মে প্রশাসনের পদোন্নতি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় তাঁরাই নানাভাবে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের একক ভূমিকা থাকায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ব্যাচেই মানা হয়নি মেধা ও জ্যেষ্ঠতার নিয়ম।
এতে প্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছেন অনেক মেধাবী কর্মকর্তা। ফলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিক্ষোভ করছেন বঞ্চিতরা। এখন প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরানোই হবে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া সচিবদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্যেষ্ঠতা ও মেধা অনুযায়ী অবশ্যই পদোন্নতি দেওয়া জরুরি। আর নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি না হলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বর্তমান সময়ে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
গতকাল জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, শেখ আব্দুর রশিদকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে, এহছানুল হককে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে, ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেনকে জননিরাপত্তা বিভাগে, ড. নাসিমুল গনিকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জন বিভাগে এবং এম এ আকমল হোসেন আজাদকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৯ অনুযায়ী পাঁচজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে তাঁদের নামের পার্শ্বে উল্লিখিত পদ, মেয়াদ ও মন্ত্রণালয়/বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হলো।’ প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবিত মেয়াদ যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী দুই বছর। এই নিয়োগের অন্যান্য শর্ত অনুমোদিত চুক্তিপত্র দ্বারা নির্ধারিত হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মোকাব্বিরকে বদলি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার তিন দিনের মাথায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মো. মোকাব্বির হোসেনকে। তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে। অন্যদিকে শনিবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) করা হয়েছে। গতকাল পৃথক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ তথ্য জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এর আগে গত ১৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব পদে নিয়োগ পান বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (জ্যেষ্ঠ সচিব) মো. মোকাব্বির হোসেন। ওই দিনই জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমির ডিজির চুক্তি বাতিল
এদিকে বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. হারুন-উর-রশিদ আসকারী, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ এবং ভারতের কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশন প্রেস উইংয়ের প্রথম সচিব (প্রেস) রঞ্জন সেনের অবশিষ্ট চুক্তির মেয়াদ বাতিল করা হয়েছে।
Leave a Reply