সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
গতকাল রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। দুদক সচিব বলেন, ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনের বিরুদ্ধে কমিশনের অনুমোদনক্রমে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান ছিল। যাচাই-বাছাই শেষে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ
অভিযোগে বলা হয়, সাইফুজ্জামান পাচারের টাকায় যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কিনেছেন ফ্ল্যাট। ২০২২ সালে লন্ডনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় একটি প্রপার্টি ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি হয়।
রিজেন্ট পার্কের খুবই কাছে এই প্রপার্টির অবস্থান। বিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অবস্থানও এর ঠিক পাশেই। লন্ডনের সবচেয়ে দামি এলাকাগুলোর মধ্যে এটি একটি। এই প্রপার্টিতে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে বেশ কিছু সাদা রঙের বাড়ি।
বাড়িগুলোতে যে জানালা আছে, এর বিস্তার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত। সর্পিলাকৃতির সিঁড়িগুলো উঠে গেছে ওপরের কয়েক তলা পর্যন্ত। সেই সঙ্গে আছে সিনেমা হল ও জিমনেসিয়াম। এই প্রপার্টির মালিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য।
অভিযোগে আরো বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন, যেখানে রয়েছে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন। যখন এই প্রপার্টিগুলো কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসন সংকট চলছিল এবং এর ৯০ শতাংশই ছিল সদ্য তৈরি করা নতুন বাড়ি।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটানে সাইফুজ্জামানের অন্তত পাঁচটি প্রপার্টি রয়েছে। এসব সম্পত্তি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে অন্তত ২৬০টি সম্পত্তি রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর। এসবের জন্য তিনি পরিশোধ করেছেন কমপক্ষে ১৩৪.৭৬ মিলিয়ন পাউন্ড বা এক হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে প্রাক-নির্বাচনী সম্পদ বিবরণী ঘোষণায় সাইফুজ্জামান তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮.৩ মিলিয়ন টাকা (২.৪ মিলিয়ন ডলার) এবং তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার বলে জানান। তিনি বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তাঁর যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি।
আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের পাহাড়
অভিযোগে বলা হয়, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়াও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। শুধু নিজের নামে নয়, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামে বিপুল সম্পদ গড়েছেন ডিএমপির সাবেক এই কমিশনার। পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোড। সেখানে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামানের নামে।
পূর্বাচলের সেক্টর-৪, রোড-১০৮-এ ৫৩ নম্বর প্লটটি আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ছিল। পাঁচ কাঠার এই প্লট বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের সবচেয়ে বড় ৩৬ নম্বর প্লটে ২১ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার। রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় ছয়তলা আলিশান বাড়ি রয়েছে আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে।
নিকুঞ্জ-১-এর ৮/এ রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীনের নামে। সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে আছাদুজ্জামানের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে। ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়ে আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ধানমণ্ডিতে এক কাঠা জমিসহ আছাদুজ্জামান মিয়ার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট।
অভিযোগে আরো বলা হয়, অন্তত দুটি কম্পানি রয়েছে আছাদুজ্জামান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মালিকানার। আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকা, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। ঢাকার গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ১০৬ শতাংশ জমি রয়েছে।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে ২০২০ সালে জোয়ারসাহারা মৌজায় পাঁচ কাঠা জমি কেনা হয়। একই বছরে একই মৌজায় কেনা হয় ১০ কাঠা জমি। একই বছরে গাজীপুরের চাঁদখোলা মৌজায় ৩১ শতক জমি কেনেন আফরোজা। এ ছাড়া ২০১৮ সালে আফরোজা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় ০.২৮ একর জমি কেনেন।
একই বছরে একই মৌজায় আরো ৩২ শতক জমি কেনেন তিনি। ওই বছরই রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় ০.৬০ একর জমি তাঁর নামে কেনা হয়। পরে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালে কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় ০.৫৭ একর জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পান আছাদুজ্জামানের স্ত্রী। একই বছরে আবার সেই জমি বিক্রিও করেন।
দুটি কম্পানির অংশীদার হয়েছেন আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা। এর মধ্যে একটি মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। এই কম্পানিতে তাঁর চার হাজার শেয়ার রয়েছে। আসাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। সে সময় মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেওয়া হয়। এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান। তিনি আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের সত্ভাই।
এ ছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের আরেকটি কম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। এই কম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত। আছাদুজ্জামানের এক শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলন। তাঁর নামে গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি রয়েছে। ভাগ্নে কলমের নামেও গাজীপুরে দেড় একর জমি আছে।
সিভিল সার্ভিস ক্যাডারের ৮৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। পরে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর নিয়োগের তিন বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। আছাদুজ্জামান মিয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩তম কমিশনার ছিলেন।
হারুন আর রশীদের অঢেল সম্পদ
অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ কিশোরগঞ্জে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামের বিলাসবহুল প্রমোদাগার। জেলার মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে।
রিসোর্টটিতে শতকোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় থেকেই হারুন তাঁর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বাড়ির পাশের হাওরে জমি কিনতে শুরু করেন। নামে-বেনামে তাঁর অন্তত ১০০ একর জমি রয়েছে। সেই সঙ্গে অন্যের শতাধিক একর জমি দখলও করেছেন। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও হারুনের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
অভিযোগে আরো বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন হারুন। লেখাপড়া শেষে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি পান। তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা না হলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরি নেন।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে তাঁর পদায়ন আটকে দেয়। এরপর ওয়ান-ইলেভেনের সময় হারুনের চাকরি স্থায়ী হয়। গাজীপুরের এসপি থাকার সময় থেকে ফুলে-ফেঁপে ওঠে হারুনের সম্পদ। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ডিবি হারুন ও আমুর ব্যাংক হিসাব জব্দ
সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ ও আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে এই নির্দেশনা দেয় সংস্থাটি। এ ছাড়া তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনও স্থগিত করা হয়েছে। ওই চিঠিতে হারুন অর রশীদ ও আমির হোসেন আমুর ছেলে, মেয়ে, মাতা, পিতা, ভাই ও বোনের হিসাবের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গতকাল রবিবার এসংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে। এর ফলে এসব হিসাবে সব ধরনের লেনদেন বন্ধ থাকবে। চিঠিতে হারুন অর রশীদ ও তাঁর স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএফআইইউ বলেছে, আগামী ৩০ দিন এসব হিসাবে কোনো লেনদেন করা যাবে না। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদন্তের প্রয়োজনে ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত করার সময় সাধারণত বাড়ানো হয়।
বিএফআইইউয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো হিসাব স্থগিত করা হলে হিসাবসংশ্লিষ্ট তথ্য বা দলিল, যেমন—হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী ইত্যাদি চিঠি দেওয়ার তারিখ থেকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছে পাঠাবে।
এই চিঠির ফলে হারুন অর রশীদের ভাই ও বোন বিএফআইইউয়ের তদারকির আওতায় আসবেন। তাঁর ভাই হলেন মিঠামইনে প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ বি এম শাহরিয়ার।
এদিকে হাসিনা সরকারের পতনের দিন রাতে ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর ঝালকাঠির বাসভবন থেকে বিদেশি মুদ্রাসহ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। পুলিশ জানায়, ৫ আগস্ট দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঝালকাঠি শহরে আমির হোসেন আমুর বাসভবনে আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা লাগেজ ভর্তি টাকা দেখতে পান। পরে বিষয়টি সেনাবাহিনী ও পুলিশকে জানালে তারা এসে লাগেজ ভর্তি ওই টাকা উদ্ধার করে।
Leave a Reply