ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সালমান এফ রহমান গত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৫৭ হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। লুট করা এসব টাকার মধ্যে সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে তিনি ৩৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আত্মসাত করেছেন ২০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সালমান এফ রহমানকে সরকারি ও বেসরকারি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে অযাচিত সুযোগ-সুবিধা পেতে সহায়তা করেছিলেন।
সূত্র জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দেশের ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেটসহ পুরো আর্থিক খাতকে দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করেছেন।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের লুটপাট করেছেন।
জানা গেছে, শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সালমান এফ রহমানের নাম গত ১৫ বছর ধরে আলোচিত ছিল। যদিও তার কেলেঙ্কারি শুরু হয়েছিল অনেক আগেই।
তার প্রতিষ্ঠান সাতটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। তার কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে পণ্য রফতানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে। স্টক মার্কেট থেকে সালমান ৬৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ।
তিনি একটি বেনামী উৎস থেকে আরো ২০ হাজার কোটি টাকার পাবলিক ফান্ড হাতিয়ে নিয়েছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করতে নীতিমালা পরিবর্তন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সালমান এফ রহমানের পরিবারের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।
এছাড়াও গ্রুপটি সোনালী ব্যাংকের কাছে ১৮ হাজার কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৯৬৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ১৪০৯ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২৯৫২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকের ৬০৩১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারবাজারে কারসাজিতে সবার আগে আসে সালমান এফ রহমানের নাম। তিনি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানির নামকরণ করে শেয়ার কারসাজি করেছেন।
আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা বিভিন্ন সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নাম উঠলেও শাস্তির মুখোমুখি হননি। সালমান এফ রহমানের কারসাজির একটি উদাহরণ হলো জিএমজি এয়ারলাইন্স। ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নেপথ্য নাম সালমান এফ রহমান। তিনি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি করেন এবং কোম্পানিতে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি করেন।
শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে তিনি লোকসানে থাকা কোম্পানি জিএমজিকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করতে লাভজনক হিসেবে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা তুলে নেয়ার পর কোম্পানিটির দুর্দশার চিত্র উঠে আসে।
অবশেষে, কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায় এবং বিনিয়োগকারীরা একটি পয়সাও ফেরত পাননি। সোনালী ব্যাংক ঋণ ফেরত পায়নি। পরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি জিএমজি এয়ারলাইন্সের সম্পত্তি নিলামের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু নিলাম হাইকোর্ট স্থগিত করে।
২০২১ সালে সুকুক বন্ড ইস্যু করে, বেক্সিমকো গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।
ব্যাংকগুলো সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করতে রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্নভাবে তাদের চাপ দেয়। সালমান এফ রহমান এসব বন্ডে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে তার সার্কুলার পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন।
তিনি ব্যাংকগুলোকে সুকুকে এই অর্থ বিনিয়োগ করতে বাধ্য করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করে বলেছিল যে ব্যাংকগুলো এই অর্থ ইসলামী বন্ডেও বিনিয়োগ করতে পারে।
ব্যাংকগুলোর শেয়ার বিক্রি ও বন্ড কেনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্য সূচক প্রায় ১২০০ পয়েন্ট কমেছে। সুকুকের পর সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠানকে ১০০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার অনুমতি দেওয়া হয়।
এই অর্থ উত্তোলনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল শ্রীপুর টাউনশিপের নামে আইএফআইসি আমার বন্ডের নামে, যেখানে ঋণদাতা গ্যারান্টর হিসাবে কাজ করে। ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ নিজের কোম্পানির উপকারে ব্যবহার করা নিয়ে নানা সমালোচনার মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়া এপ্রিল মাসে ১৫ বিলিয়ন টাকা তোলার জন্য জিরো কুপন ইস্যু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
২০০৬ সালের মাঝামাঝি সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক দখলের চেষ্টা করেন।
দরপত্রে অংশগ্রহণ করে সৌদি যুবরাজ বন্দর বিন মুহাম্মদ আবদুল রহমান আল সৌদ রূপালী ব্যাংকের ৯৩ শতাংশ শেয়ারের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়েগ প্রস্তাব দেন। লেনদেন শুরু হওয়ার আগে সালমান রূপালী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার ৪০০ টাকায় কিনেছিলেন। পরে জানা যায়, এই নামের কোনো সৌদি যুবরাজ নেই।
এক ব্যক্তিকে ভুয়া সৌদি যুবরাজের ছদ্মবেশে রূপালী ব্যাংক কেনার নাটক সাজানো হয়েছে। এরপর রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়ে ৩ হাজার ৪০০ টাকায় দাঁড়ায় এবং সালমান জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা লুট করেন।
Leave a Reply