কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশব্যাপী সেনাবাহিনী নিয়োগ করার পর আন্দোলনের পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ফিডব্যাক নিতে গত ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা সদরে বিভিন্ন স্তরের সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
দেশের অন্যান্য ফরমেশনের কর্মকর্তারাও ভার্চুয়ালি ওই মতবিনিময় সভায় যুক্ত ছিলেন। মতবিনিময়কালে অনেকেই এ আন্দোলন দমনে যে কোনো নেতিবাচক ভূমিকা সেনাবাহিনীর জন্য বদনাম বয়ে আনবে বলে মতপ্রকাশ করেন।
সেনাপ্রধান সামরিক কর্মকর্তাদের মনোভাবের কথা উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নেন, যে কোনো উসকানিতেও সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করবে না। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের মিছিলকে সেনাসদস্যরা কোনো ধরনের প্রতিহত কিংবা বাধা দেবে না।
মিছিল চলাকালে সেনাসদস্যরা বরং সরে গিয়ে জায়গা করে দেবে। এ খবর যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আন্দোলনের মোড়ই ঘুরে যায়। খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে।
ওইদিনের বৈঠকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রায় আধা ঘণ্টার একটি উদ্বোধনী বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন সেনাবাহিনীকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় নিয়োগ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার যদি সেনাবাহিনীকে সংকট মোকাবেলায় নিয়োজিত করে তাহলে তারা সেই আদেশ মানতে বাধ্য। তবে তিনি যোগ করেন, তার সেনারা কাউকে হত্যা করেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কতগুলো গুলি এবং ফাঁকা গুলি চালানো হয়েছে— তার পরিসংখ্যানও তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন।
কর্মকর্তাদের সংযত থাকার পরামর্শ দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আমাদের দেশে ১৯৭০ সালের পর এমন গণবিক্ষোভ আর কখনো হয়নি। তাই এটি একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
বক্তব্য শেষে সেনাপ্রধান বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান। ব্রিগেডিয়ান জেনারেল এবং এর চেয়ে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা হাত তুললেও সেনাপ্রধান তাদের নিরুৎসাহিত করেন এবং তরুণ কর্মকর্তাদের কথা শোনার প্রতি জোর দেন।
সেদিন ৬ থেকে ৭ জন কর্মকর্তা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা শোনান।
রাজশাহীর একজন নারী সেনা কর্মকর্তা বাংলায় একটি আবেগপূর্ণ বক্তৃতা পাঠ করে বলেন, দেশের সব মাকে মৃত্যু স্পর্শ করেছে এবং সব মা কাঁদছেন।
তিনি মীর মুগ্ধর প্রতিবেশী ছিলেন, যে মুগ্ধ ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করার সময় নিহত হন।
নারী কর্মকর্তা মেজর হাজেরা জাহান এই ঘটনায় শিশুদের প্রাণহানি ও এর ন্যায্য বিচার হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের অসন্তোষ বাড়তে থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেনাপ্রধান তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি গুলির ঘটনা সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ক্যাপ্টেন বর্ণনা করেন যে কীভাবে কর্তব্যরত সেনা সদস্যদের জনতা ঘিরে ধরেছিল এবং তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গুলি চালাতে হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমি আমার নিজের পরিবারের সদস্যদের থেকে, আমার বন্ধুদের থেকে এবং আমার প্রিয়জনদের থেকে সমালোচনার শিকার হয়েছিলাম। তারা ভিডিওটি দেখেছিলেন। আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সমালোচনার পরে আমি হতাশাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম।
দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে মধ্য বিরতি দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়েছিল, বিরতির পর আরও কর্মকর্তারা কথা বলবেন।
সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের সমর্থন কমে যাওয়ার কথা তুলে ধরে সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন ৫ এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব। চট্টগ্রামের আরেক কর্মকর্তা আহত শিক্ষার্থীদের সহায়তার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করার পরামর্শ দেন।
এছাড়া ৪ আগস্ট আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে রাওয়া ক্লাবে। সেদিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি একযোগে সংহতি প্রকাশ করেন। এ খবর দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটিও সেদিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সব শ্রেণির সদস্যদের কাছে দেশ ও জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করেছিল। বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি করবে না, শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি।
তিনি চেয়েছিলেন, পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যরাও আন্দোলন দমনে যা কিছু প্রয়োজন, তাই করবে। তাতে আরও বেশি রক্তপাত হতো; এ কথা বিবেচনা করে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাদের অপারগতার কথা জানিয়ে দেন। এভাবেই সেনাবাহিনী সেদিন শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
Leave a Reply