বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারকে অবরুদ্ধ করে পদত্যাগে বাধ্য করে শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত লোকজন। গত ২৯ আগস্টের ওই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন কলেজের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় এক বিএনপি নেতার ছেলে।
তবে শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাসির জমাদ্দার দাবি করেন, অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারের পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় ছাত্রদলের কেউ জড়িত ছিল বলে তথ্য নেই। এটি সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে বলে শুনেছি।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট দুপুরে শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত একদল লোক প্রায় চার ঘণ্টা ধরে অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। অবরুদ্ধ অবস্থায় অধ্যক্ষের অসহায় অবস্থার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো নিন্দার ঝড় উঠেছে। শুক্লা রানীর হালদারের অসহায় অবস্থার ছবি দিয়ে ঘটনার প্রতিবাদে নেমেছেন তার প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্থানীরা।
এর মধ্যে অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও পদত্যাগে বাধ্য করানোর ঘটনার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারও সম্পৃক্ততা ছিল না বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাকেরগঞ্জের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী কে এম হাসিবুল আলম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা শুক্লা রানী হালদার ২০২২ সালের মাঝামাঝি বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। এর আগে তিনি বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে কলেজে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ বিক্ষোভে বেশির ভাগই ছিলেন বিএনপির কর্মী। বিক্ষোভে অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, কলেজে নিয়মিত উপস্থিত না হওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে তার পদত্যাগ দাবি করা হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা তার অফিস কক্ষে ঢুকে পদত্যাগ করতে চাপ প্রয়োগ করেন। এরপর বেলা দুইটার দিকে শুক্লা রানী হালদারকে একটি সাদা কাগজে ‘পদত্যাগ করলাম’ লিখতে বাধ্য করা হয়। পরে নিচে তার সই ও সিল দিতে বললে তা-ও দিয়ে দেন তিনি। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
তবে অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি অভিযোগেরও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাদের একটি পক্ষ শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের ব্যবহার করেছেন।’
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা ছিলেন সরকারি বিএম কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রথম নারী শিক্ষক ও প্রথম নারী চেয়ারম্যান। অধ্যাপক শুক্লা রানী হালদার ছিলেন তার অনুজ সহকর্মী। শাহ সাজেদা বলেন, ‘শুক্লার মতো শিক্ষকের সঙ্গে এমন আচরণ দেখে নীরবে চোখের জল ফেলেছি। ও আমার জুনিয়র সহকর্মী। আমি যখন ওর অসহায়, বিধ্বস্ত ছবিটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি, তখন থেকে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। একজন নারী শিক্ষকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ অগ্রহণযোগ্য।’
সরকারি বিএম কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিতা মিতু লিখেছেন, ‘বরিশাল বিএম কলেজের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক শুক্লা রানী ম্যাম ছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক। বর্তমানে তিনি বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ। তাকেও পদত্যাগ করানো হলো। তিনি অসাধারণ, সদা হাস্যোজ্জ্বল, আনন্দপ্রিয় একজন মানুষ। আসলে ম্যাম, আপনাদের মতো মানুষ সত্যিই এদের যোগ্য নয়। এদের কোনো যোগ্যতাই নেই। ক্ষমা করবেন ম্যাম।’
এম এম জুবায়ের নামের বরিশাল সরকারি আইএইচটির প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বরিশাল সরকারি আইএইচটিতে পড়ার সময় ম্যামকে পেয়েছিলাম গেস্ট টিচার হিসেবে। সদা হাস্যোজ্জ্বল এবং উদার মনের শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক। বিএম কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, বর্তমানে বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ। আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে কেউ ফায়দা লুটছে। তার ছাত্র ও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি ও সুষ্ঠু তদন্ত চাচ্ছি। ক্ষমা করবেন, ম্যাম।’ এমন অনেক লেখা ও মন্তব্য ঘুরছে ফেসবুকের ওয়ালে।
বিসিএস ক্যাডার এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘শুক্লা ম্যাম আমার শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান। শিক্ষার্থীরা ছিল সবাই তার ছেলেমেয়ে। তার মতো এক আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ মানতে পারছি না।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাকেরগঞ্জের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী কে এম হাসিবুল আলম বলেন, ‘কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি ছিল। এ ঘটনায় তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেহেতু তাকে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে একটা ক্ষোভ থাকলেও থাকতে পারে। তবে একজন শিক্ষক, তার ওপরে একজন বিসিএস ক্যাডার, তাকে যে প্রক্রিয়ায় পদত্যাগ করানো হয়েছে, সেটা আইনসিদ্ধ নয় এবং গ্রহণযোগ্যও নয়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তা প্রমাণের জন্য প্রশাসনিকভাবে তদন্ত করা যেত, কিন্তু এভাবে কাউকে জোর করে হেনস্তা করা উচিত হয়নি।’
অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদার বলেন, ‘আমি যাদের পড়িয়েছি, তাদের কয়েকজন আমাকে চরম অপমান করেছে। তবে শিক্ষার্থীর চেয়ে এখানে বহিরাগত বেশি ছিল। কোনোভাবে ওদের শান্ত করতে না পেরে “পদত্যাগ করলাম” লিখে দিয়েছি। এখন পুরো বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, আমিও শুনেছি, অধ্যক্ষের কাছ থেকে ‘পদত্যাগ করলাম’ লেখা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এভাবে তো পদত্যাগ হয় না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। জেলা প্রশাসককে সব জানিয়েছি।
Leave a Reply