ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্সে’ বাংলাদেশের ভূমিকা কী?

বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দু’দিন আগে ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভি-কে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ – সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।’

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের কয়েক দিনে বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্র বা চ্যানেলকেও দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারেও তিনি মোটামুটি একই ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন, আর প্রতিবারই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন এই ‘সেভেন সিস্টার্স’ শব্দবন্ধটি।

লক্ষণীয় বিষয় হল, ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বোঝাতে এখন কিন্তু ‘নর্থ-ইস্ট’ বা ‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ কথাটাই বেশি ব্যবহৃত হয়। সেভেন সিস্টার্স কথাটা এককালে জনপ্রিয় হলেও এখন ভারতীয়রা সেটি প্রায় ভুলতেই বসেছেন।

অথচ ভারতে ‘সেভেন সিস্টার্স’ কথাটা ইদানীং প্রায় অপ্রচলিত হলেও বাংলাদেশে ওই অঞ্চলটিকে বোঝাতে এখনও কিন্তু ওই শব্দবন্ধটিই সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত।

এমন কী দিনকয়েক আগে বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার পর কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্রকে স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছিল, ‘বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!’ সেই দৃশ্যের ভিডিও প্রবল বেগে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও।

তথাকথিত ‘সেভেন সিস্টার্সে’র ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকা না-থাকার প্রশ্নে বাংলাদেশের যে একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, সম্ভবত সেই ইঙ্গিতই প্রচ্ছন্ন ছিল শিক্ষার্থীদের ওই স্লোগানে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও বারবার এই বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছেন।

শিলিগুড়ি করিডর তথা ‘চিকেনস নেক’: ভারতে সাড়ে চার বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ তুঙ্গে, তখন শার্জিল ইমাম নামে এক তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট এক জনসভায় বলেছিলেন, ভারতের ‘চিকেনস নেক’ অবরোধ করে আসামকে পাকাপাকিভাবে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেই সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে!

মুম্বাই আইআইটি ও দিল্লির জেএনইউ-এর সাবেক ছাত্র, মেধাবী শার্জিল ইমামের সেই ভাষণের ভিডিও ভাইরাল হয় – যার জেরে দেশদ্রোহের অভিযোগে তাকে পরে জেলেও যেতে হয়, আর সেই কারাবাস থেকে তিনি আজও মুক্তি পাননি।

একদা সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাকি দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে যে সরু অংশটা, সেটাই আসলে ‘শিলিগুড়ি করিডর’ নামে পরিচিত।

ভারতের মানচিত্রে শিলিগুড়ি শহরের কাছে অবস্থিত এই করিডরটা অনেকটা বাঁকানো মুরগির ঘাড়ের মতো দেখায় বলে এই জায়গাটাকে অনেকে ‘চিকেনস নেক’ বলেও বর্ণনা করেন।

এই করিডরের সবচেয়ে সরু অংশটা মাত্র ২১ কিলোমিটার চওড়া, যার আশেপাশেই রয়েছে অন্তত চারটি দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত। এই দেশগুলো হল চীন, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ।

বাকি ভারতের সঙ্গে সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক সংযোগের এই সূত্রটায় যেহেতু ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথে’র অভাব রয়েছে, সেটাই কিন্তু নিরাপত্তার দৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে একটা ‘ভালনারেবল’ বা বিপজ্জনক অবস্থায় রেখেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক তথা ভারতীয় সেনার সাবেক মেজর জেনারেল ভি এস রানাডে মনে করেন, এই শিলিগুড়ি করিডরের ‘স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব’ হয়তো ভারত উপলব্ধি করেছে – কিন্তু অন্য দিকগুলো দিয়ে সেভেন সিস্টার্সকে আজও বাকি দেশের সঙ্গে আত্মীকৃত করা যায়নি।

দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র জার্নালে ‘স্লেন্ডার ইজ দ্য করিডর’ নামে এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘যে ইস্যুগুলো একটা দেশের বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করে, সেটা এখানে কোথায়? এই করিডর দিয়ে আমরা কি (সেভেন সিস্টার্সকে) রাজনৈতিকভাবে বা জাতীয় আবেগের দিক থেকে জুড়তে পেরেছি?’

শিলিগুড়ি করিডরের কাছেই অবস্থিত দার্জিলিং-এর আদি বাসিন্দা ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আবার এই সরু করিডরকে ভারতের জন্য একটি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখতে চান।

শ্রিংলা বলছেন, ‘ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি (‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’) আর ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি এখানে এসেই মিশেছে। আমি তো বলব শিলিগুড়ি করিডর হল আসিয়ান, বিমস্টেক আর সার্কের সংযোগস্থল!’

তবে যে দৃষ্টিতেই দেখা হোক, এই করিডর বা ‘চিকেনস নেক’ই যে সেভেন সিস্টার্সকে বাকি ভারতের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে রেখেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ আর সেভেন সিস্টার্স: মিজোরামের দু’দুবারের মুখ্যমন্ত্রী, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নেতা জোরামথাঙ্গা বছর দুয়েক আগে এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সাহায্য না-পেলে তাদের মিজো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনওই সাফল্যের মুখ দেখত না এবং মিজোরাম একটি পৃথক রাজ্য হিসেবেও হয়তো আত্মপ্রকাশ করতে পারত না।

আসলে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) বিদ্রোহীরা ষাটের দশকের শেষে প্রায় তাদের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) আশ্রয় পেয়েছিলেন, যা অব্যাহত ছিল প্রায় দীর্ঘ দু’দশক ধরে।

এমএনএফের প্রবাদপ্রতিম নেতা লালডেঙ্গা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আতিথেয়তায় ঢাকার লালমাটিয়া এলাকাতে একটি বাড়িতেই থাকতেন, আর ওই গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক ভ্যালি ও তার আশেপাশের এলাকায়।

তখনকার তরুণ জোরামথাঙ্গা ছিলেন সুপ্রিম কমান্ডার লালডেঙার বিশ্বস্ত অনুচর ও ছায়াসঙ্গী। ১৯৮৭তে ভারতে মিজো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পৃথক মিজোরাম গঠনের পথ প্রশস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ও তার বহু সতীর্থ জীবনের বেশিটা সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন।

একই কথা খাটে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলফা-র পরেশ বড়ুয়া, অনুপ চেতিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো সর্বোচ্চ নেতাদের অনেকের ক্ষেত্রেই। তাদের সশস্ত্র আন্দোলনের অনেকটা সময়ই তারা ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে।

ত্রিপুরার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এনএলএফটি কিংবা ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্সের (যার নেতা বিজয় কুমার রাংখল এখন একজন মূল ধারার রাজনীতিক) সদস্যরাও অনেকেই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছেন, সেখান থেকেই পরিচালিত হত তাদের কর্মকাণ্ড।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন (১৯৯১-৯৬ ও ২০০১-০৬) বাংলাদেশ সরকার অবশ্য কখনওই তাদের দেশের মাটিতে এই সব গোষ্ঠীগুলির অস্তিত্ত্ব স্বীকার করেনি – আর এই ইস্যুটিও ঢাকা-দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল।

২০০৯-এ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদে এই দৃশ্যপটে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে হাসিনা সরকার একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গোপনে বা প্রকাশ্যে ভারতের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। বাংলাদেশের মাটিতে ওই সব গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরও একে একে বন্ধ হতে থাকে।

আলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া অবশ্য তার আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু অনুপ চেতিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো গোষ্ঠীর অন্য নেতারা ততদিনে ভারতে ফিরে এসে সরকারের সঙ্গে ‘শান্তি আলোচনা’ও শুরু করে দিয়েছেন।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সেভেন সিস্টার্স যে নিরাপত্তাগত দৃষ্টিতে গত এক দশকে অনেকটাই স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ – তার পেছনে শেখ হাসিনা সরকারের অবদান ভারতের কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকরাও তাই অকুণ্ঠে স্বীকার করেন।

সেভেন সিস্টার্সের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের আর একটি বড় উপহার ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া।

এই দুটি বন্দর ব্যবহারের সুযোগ স্থলবেষ্টিত সেভেন সিস্টার্সকে শুধু সামুদ্রিক বাণিজ্যের নতুন দিগন্তই খুলে দেয়নি, ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্বও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে সেই সুযোগ আরও বাড়বে নিশ্চিতভাবে।

মিয়ানমারের মধ্যে দিয়ে ভারত যে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রোজেক্ট বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছিল, সেটার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও অনেক কমে গিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের ফলে।

কারণ মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরের বদলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে পণ্য পরিবহন করা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য তুলনায় অনেক সহজ।

ফলে এক কথায় বলতে গেলে ‘সেভেন সিস্টার্সে’র সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি, তা তারা সারা জীবন মনে রাখবে!’

বহুল-আলোচিত সেই মন্তব্য নিয়ে পরে বহু চর্চা হলেও শেখ হাসিনা সে দিন ঠিক কী দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তা কখনওই ভেঙে বলেননি বা স্পষ্ট করেননি।

কিন্তু দুই দেশেই পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা ধারণা করে থাকেন, তিনি সেদিন সেভেন সিস্টার্সে শান্তি ও প্রগতি ফিরিয়ে আনার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন – ভারতের যে অঞ্চলটি ঢাকায় ক্ষমতার পালাবদলের পর আবার নতুন করে আলোচনায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *