ভয়াবহ বন্যার পানি সরলেও এখনো ক্ষত শুকায়নি বন্যাকবলিত ফেনীর অনেক এলাকায়। কারও ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। ভিজে নষ্ট হয়েছে খাট, তোশক-বালিশসহ প্রয়োজনীয় সব আসবাব। ফলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরেও নিজের ঘরে থাকতে পারছেন না তারা।
ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শাহানা আক্তার। দুই কক্ষের দোচালা টিনের ঘরে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতেন। তার ঘরের দুটো কক্ষই এখন শুধু বোঝা যায়। নষ্ট হয়েছে ঘরের সব আসবাব। নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে জাগো নিউজকে শাহানা বেগম বলেন, ‘আঁরে (আমাকে) কদ্দুর (একটা) ঘরের ব্যবস্থা করি দেন। দয়া করি আঁর নামাজ-কলমা হড়ার (পড়ার) ব্যবস্থা করি দেন। আঁই (আমি) বহুত (অনেক) অসহায়।’
তিনি বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে গেছে সাতদিন হলো, এখনো থাকার ঘর খুঁজি। বন্যার পানিতে ঘরের সব নষ্ট হয়ে গেছে। পিচ্ছিল কাদামাটিতে হাঁটতে হাঁটতে দুই পা ক্ষত। স্বামী থাকে মসজিদে, আমি প্রতিবেশীর ঘরে রাতে থাকি। ঘরের দুইটা খাট ও তোশক-বালিশ সব ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।’ সেদিন পানি বাড়ার পর যখন দেখলাম ঘরে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না, তখন পাশের বাড়ির ছাদে চলে যাই। এরপর ১০ দিন সেখানে ছিলাম। পানি সরে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে দেখি ঘরের মাটি সরে কোথাও গর্ত কোথাও উঁচু হিয়ে গেছে। ঘরের চালের টিন নষ্ট হয়ে এখন পড়ে পড়ে যায় যায় অবস্থা।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই কক্ষের দোচালা টিনের ঘরে এখনো রয়েছে বন্যার ক্ষত। বন্যার পানির স্রোতের তোড়ে মাটি সরে মেঝের বিভিন্ন জায়গায় গর্ত হয়ে আছে। সেগুলো মেরামত করছিলেন শাহানা বেগম। ঘরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাজানো গোছানো এ ঘরে এখন শুধু দুইটি কক্ষ দৃশ্যমান। বাকিসব আসবাব নষ্ট হয়ে এলোমেলো পড়ে আছে।
শাহানা বেগম বলেন, ‘আগামী তিন-চারদিনেও থাকার উপযোগী হবে না এই ঘর। এই কয়েকদিন বাইরেই (অন্যদের ঘরে) থাকতে হবে।’
বন্যার ভয়াবহতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সেদিন পানি বাড়ার পর যখন দেখলাম ঘরে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না, তখন পাশের বাড়ির ছাদে চলে যাই। এরপর ১০ দিন সেখানে ছিলাম। পানি সরে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরে দেখি ঘরের মাটি সরে কোথাও গর্ত কোথাও উঁচু হিয়ে গেছে। ঘরের চালের টিন নষ্ট হয়ে এখন পড়ে পড়ে যায় যায় অবস্থা।’
অসুস্থ থাকায় স্বামী তেমন রোজগার করতে পারেন না জানিয়ে শাহানা বলেন, ‘রান্নাবান্না সব বন্ধ হয়ে গেছে। বাথরুম ভেঙে ভেছে। আমাকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন, অনেক অসহায় হয়ে গেছি।’
এসময় পাশে থাকা তার স্বামী কবির হোসেন বলেন, ‘সব শেষ। মাঝেমধ্যে রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। এখনো মসজিদে থাকি। ঘর মেরামত না হওয়ার পর্যন্ত মসজিদেই থাকতে হবে।’
শাহানার পরিবারের মতো এ বাড়ির আরও তিন পরিবারের ঘরগুলোও এখন থাকার অনুপযোগী। এসব পরিবারের সদস্যরা মসজিদ, প্রতিবেশীর ঘর কিংবা রান্নাঘরে রাত কাটাচ্ছেন এখন।
কথা হয় কবিরুল হক নামের আরেক বন্যাদুর্গত ব্যক্তির সঙ্গে। জাগো নিউজকে কবিরুল বলেন, ‘যা গেছে তা আর পাবো না। এই ঘর মেরামত করতে এখনো সাতদিন লাগবে। একটা কক্ষ কোনোমতে ঠিক করেছি, ওখানে স্ত্রী-সন্তান থাকে। আশপাশের কোথাও শক্ত মাটি নেই, দূর থেকে মাটি এনে ঘরের মেঝে ভরাট করছি। রান্নাঘর এখনো মেরামত করতে পারিনি। অন্যের ঘরে রান্না করে কোনোরকম দিন যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, `জন্ম সনদ, এনআইডি কার্ড সব ভিজে নষ্ট হিয়ে গেছে। এগুলো ফের তৈরি করতে আরেক পেরেশানি হবে। সবকিছু স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে।’আমাদের গ্রামে নাক বরাবর পানি ছিল। এই গ্রামের এখনো অন্তত ১০০ মানুষ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ে আছেন। তাদের ঘর থাকার উপযোগী না। সঠিক পুনর্বাসন না হলে এসব মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে।
এই বাড়ির শিশু ফাহিম পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। সে জানায়, ঘরে তার ৮টি বই ছিল। এগুলোর মধ্যে ৫টি ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি ৩টি রোদে শুকিয়ে কোনোরকম পড়া যাচ্ছে।
ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের ব্লাড ডোনেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এবং আরও তিনটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একসঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের গ্রামে নাক বরাবর পানি ছিল। এই গ্রামের এখনো অন্তত ১০০ মানুষ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ে আছেন। তাদের ঘর থাকার উপযোগী না। সঠিক পুনর্বাসন না হলে এসব মানুষকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে।’
ফেনী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুলতানা নাসরিন কান্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দুর্যোগ অধিদপ্তর থেকে এখনো বরাদ্দ আসেনি। কবে আসবে সেটিও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন এনজিও এসে এখন যারা আশ্রয়হীন বা যাদের সাহায্য প্রয়োজন তাদের তালিকা করছে। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করতে আমরা কমিটি গঠন করেছি।’
Leave a Reply