অবশেষে প্রকাশ্যে এসেছে বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমানের খেলাপি ঋণের হিসাব। যার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা।
জনতা ব্যাঙ্কের একটি শাখা থেকে ঋণের নামে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি। যা ওই শাখার মোট ঋণের ৬৫ শতাংশ। ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি খেলাপি হয়েছে। এসব ঋণের বেশির ভাগই ছিল বেনামে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নেয় এবং তাদের নামে বেনামি ঋণ বাজেয়াপ্ত করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও জনতা ব্যাংকের নথিতে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে একজন ব্যাংকার বলেন, সালমান এফ রহমান বেনামি ঋণের জনক। যা ধীরে ধীরে পুরো ব্যাংকিং খাতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের অধিকাংশ ঋণই বেনামী। এখন প্রায় সব অসাধু ব্যবসায়ীরই বেনামি ঋণ রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হচ্ছে বেনামি ঋণের কারণে। তার মানে একজন ঋণ নেয় এবং অন্যজন তা উপভোগ করে। প্রকৃত সুবিধাভোগীরা সর্বদা অধরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সব ধরনের বেনামি ঋণ সনাক্ত করা। তা না হলে ব্যাংকিং খাত টিকবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেক্সিমকো গ্রুপের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে ২৬ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ৩২টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে সুকুক বন্ডের নামে ২২০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। এই ঋণের অধিকাংশই ২০২১, ২২ এবং ২৩ সালে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস ৬০৯ কোটি, অ্যাপোলো অ্যাপারেলস ৭৯৮ কোটি, অটামলুপ অ্যাপারেলস ৮২২ কোটি, বে সিটি অ্যাপারেলস ৮৯২ কোটি, বেক্সিমকো লিমিটেড ২ হাজার ২১৬ কোটি, বেক্সিমকো পিপিই ২৬ কোটি, বেক্সিমকো ফ্যাশনস ৯৮৬ কোটি, গারপোলি ৯৩৮ কোটি টাকা ৬১ কোটি, আরামদায়ক পোশাক ৯০৬ কোটি, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন ১ হাজার ৬৯০ কোটি, এসকর্প অ্যাপারেলস ৮১৯ কোটি, এক্সেস ফ্যাশনস ১ হাজার ৭৫৮ কোটি, আন্তর্জাতিক নিটওয়্যার এবং পোশাক ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ইউনিট-২ ৬৪৯ কোটি, কাঁচপুর অ্যাপারেলস ৭৫৯ কোটি, মিডওয়েস্ট গার্মেন্টস ৭৩২ কোটি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ১,৬৮৬ কোটি, পিয়ারলেস গার্মেন্টস ৯৬০ কোটি, পিঙ্ক মেকার অ্যাপারেলস ৯০২ কোটি, প্লাটিনাম গার্মেন্টস ৮৩৭ কোটি, শাইনপুকুরের পোশাক ৩৩ কোটি, শাইনপুকুর ৩৩ কোটি টাকা। ৭৩৮ কোটি, স্প্রিংফুল অ্যাপারেলস ৭৬০ কোটি, আরবান ফ্যাশন ৭০৪ কোটি, হোয়াইট বে অ্যাপারেলস ৮৮৫ কোটি, আন্টার স্প্রিন্ট গার্মেন্টস ৭৭২ কোটি, ইয়োলো অ্যাপারেলস ১,৫০০ কোটি, ক্রিসেন্ট অ্যাকসেসরিজ ৯৬ কোটি, আরআর ওয়াশিং ৯৭ কোটি, এসকর্প এলপিজি ১১ কোটি ৬৩ কোটি এবং বিসিএক্সেক্স ফার্মা। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই ছিল বেনামী প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে।
একজন গ্রাহক বিভিন্ন হারে জামানত রেখে ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন। সালমান এফ রহমানের ক্ষেত্রে তাদের কাউকেই গ্রহণ করা হয়নি। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি এসব ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা তাকে সাহায্য করেন। এরপর পরিচালনা পর্ষদ ও এমডির নির্দেশনা থাকলে অনেক সময় কর্মকর্তাদের কিছুই করার থাকে না।
এত বড় ঋণ নেওয়ার সময় জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন আবদুচ ছালাম আজাদ। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির ও আবদুর রউফ তালুকদার। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পলাতক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের। অর্থ সচিব থেকে গভর্নর পর্যন্ত আবদুস সালাম আজাদকে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ কারণে আবদুচ সালাম আজাদকে অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন সাবেক গভর্নর ফজলে কবির।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানুষ হত্যার দায়ে সে এখন কারাগারে। আর্থিক অপরাধের জন্যও তাদের বিচার করা যেতে পারে। এরপর ব্যাংকের এমডি, বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকও এ প্রক্রিয়ায় জড়িত। কারণ তিনি কারও অজান্তে এক শাখা থেকে এত টাকা উত্তোলন করেননি। সবাই জানে। তাই সুষ্ঠু তদন্ত করে সবার শাস্তি হওয়া উচিত। তার আগে টাকা সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন। কোনো নিরাপত্তা অবশিষ্ট থাকলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। আর শুধু একটি শাখা নয়, কোথা থেকে কত টাকা, সবই খুঁজে বের করতে হবে।
Leave a Reply