পূজা আসলেই আলোচনায় আসে ভারতে ইলিশ পাঠানোর প্রসঙ্গ। হাসিনা সরকারে থাকাকালীন ভারতকে কখনোই এতোটা আলোচনা করতে হয়নি ইলিশ নিয়ে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে গঠন করা হয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার আসার পর থেকে দেশের নাগরিকদের মধ্যে বেড়ে যায় বিরত বিরোধিতা। যার কারণে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয় নানা চাপ। সরকারের উপদেষ্টারা প্রথমে ভারতে মাছ পাঠাতে না চাইলেও পরবর্তীতে ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি আদেশ জারি করা হয়।
গত ২১ সেপ্টেম্বর ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতিসংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের ইলিশ রফতানির এ সিদ্ধান্তে চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়। এসব বিষয়ে জানতে আইন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের মুখোমুখি হন নিউইয়র্ক থেকে সম্প্রচার হওয়া ঠিকানা টিভির প্রধান সম্পাদক খালেদ মুহিউদ্দীন।
মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাতে সম্প্রচার হওয়া ওই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ সময় সংবাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৫০০ টন ইলিশ রফতানি করা হয়েছিল। তখন আপনি (আসিফ নজরুল) বলেছিলেন কেন ইলিশ রফতানি করা হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ৩ হাজার টন ইলিশ রফতানি করছে। এর কারণ কী?
খালেদ মুহিউদ্দীনের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, যখন ইলিশ রফতানির স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, তখন আমি উপদেষ্টা ছিলাম না। গত বছর ৩ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ রফতানির সর্বোচ্চ অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এ বছর তারচেয়ে কম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার টন। পরিসংখ্যানের দিক থেকে ৩ হাজার ৯৫০ টনের সঙ্গে ৩ হাজার টনের তুলনা করতে হবে। ৫০০ টনের যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম তা দ্বিতীয় ফেজে রফতানি হয়েছিল। গত বছর আসলে রফতানি হয়েছিল ৮০২ টন। এ নিয়ে পত্রিকায়ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। আর এ বছর প্রকৃত রফতানি কত হবে শেষ পর্যন্ত দেখেন।
‘যখন ইলিশ নিয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম আমি বলেছিলাম, ৫০০ টন ইলিশ কেন পাঠানো হচ্ছে? ভারতকে খুশি করানোর জন্য, যারা আমাদের পানি দেয় না, যারা সীমান্তে হত্যা করে, যারা আমাদের নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করে। যদি ভারতের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে কিংবা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে- এর আলোকে আপনি ইলিশ রফতানি করবেন কী করবেন না সেটা মানুষের মাথা ব্যথা থাকতো না,’ যোগ করেন আসিফ নজরুল।
ভারতের প্রতি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানুমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে মানুষ মারা যাচ্ছে আর বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য ছিল লাশটা নিয়ে আসা। মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা শেখ হাসিনার সরকার সমর্থন করতো। বলতো, আমাদের লোক অপরাধ করে, সীমান্তে যায় দেখে মারা যায়। কিন্তু আমরা পানি পাচ্ছি না, তার জন্য প্রতিবাদ করতো না। অথচ ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিচ্ছে।’
‘আমাদের দেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার দেশ নেপাল আর ভুটানের সামান্য ট্রানজিটও পাচ্ছে না। দিনের পর দিন ভারতের শাসকরা আমাদের দেশ সম্পর্কে অত্যন্ত অবমাননাকর অপমানজনক উক্তি করতো। এতে আমাদের মন বিষিয়ে থাকতো সব সময়। এমন একটা দেশকে নিয়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে থাকতেন, ভারতকে যা দিয়েছি কখনও তারা ভুলতে পারবে না। তখন মনে প্রশ্ন জাগতো, এটা কি আপনার পৈতৃক সম্পত্তি, আপনি যা ইচ্ছা দেবেন,’ বলেন আসিফ নজরুল।
ক্ষোভ প্রকাশ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আপনি এমন একটা দেশকে এই জিনিসগুলো দিচ্ছেন যারা সীমান্তে আমাদের মানুষ মারে, পানি দেয় না, ওটা দেয় না। সেই ক্ষোভ থেকে তখন অনেক কিছু বলেছি। এখন আর সেই সরকার নেই। এখন কি আমার সরকার সীমান্তে হত্যা হলে প্রতিবাদ করে না? কঠোরভাবে প্রতিবাদ করে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি একটা বক্তব্য দিয়েছেন, তার বক্তব্য দেখেন কত কড়াভাবে বলা হয়েছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ভারত সম্পর্কে কীভাবে কথা বলেন সেটা দেখতে হবে। আমি প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে কীভাবে ভারত সম্পর্কে কথা বলেছি সেটা দেখতে হবে। বর্তমানে ইলিশ রফতানি নিয়ে অনেকগুলো যুক্তি রয়েছে।
বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হলেও ভারত সরকারের আচরণগত পরিবর্তন হয়নি। গত সরকার (আওয়ামী লীগ) কড়া কথা বলতো না, ইলিশ দিতো। তার মানে আপনারা কড়া কথা বলছেন আবার ইলিশও দিচ্ছেন। এটা কি সিম্বোলিক যে, আপনারা ভারতের সঙ্গে একই রকম সম্পর্ক রাখবেন, শুধু কিছু কড়া কথা মাঝখানে বলবেন। ব্যাপারটা কি এ রকম?
খালেদ মুহিউদ্দীনের- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘না, এমন না। ইলিশ রফতানি নিয়ে আমি অনুসন্ধান করেছি, বিভিন্ন কথা শুনেছি। তখন একটা কথা বলা হয়েছে- আমাদের ছাত্র-জনতার যে বিপ্লব হয়েছিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমর্থন ছিল। তারা আমাদের ওখানকার দূতাবাসের সামনে কর্মসূচি পালন করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কড়া ভাষায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সমালোচনা করেছিলেন এবং এটা নিয়ে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। ইলিশ প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য যাচ্ছে। এগুলো কিন্তু আমার যুক্তি না, এসব আমি শুনেছি। আরেকটা বিষয়, মোট যে ইলিশ রফতানি করা হচ্ছে সেটা শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ।’
‘সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রি-অ্যালাইনমেন করতে যাচ্ছি। ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে যাচ্ছি। যেখানে আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কেন্দ্র, বর্ডার কিলিং ইস্যু রয়েছ, সেখানে একটা অপেক্ষাকৃত লঘু বিষয়ে আমরা তাদের বার্তা দিতে চাই না, তোমাদের সঙ্গে হোস্টআই। আমরা ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে ইলিশের মতো ছোট একটা জিনিস নিয়ে আঘাত করতে চাই না,’ বলেন আসিফ নজরুল।
মমতা ব্যানার্জি এখন তার দেশে কিংবা তার প্রদেশে একটি ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছেন। তাকে সেফ করার জন্য আপনারা ইলিশ মাছ দিচ্ছেন। এতে মোদি সরকার বিরক্ত হবে বিব্রত হবে, সেটা আপনাদের লক্ষ্য- এটাও অনেকে বলছেন।
খালেদ মুহিউদ্দীনের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি সেভাবে বলতে চাচ্ছি না। আমি শুধু শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা শক্তভাবে নিন্দা করেছেন। ইলিশ পাঠানো বন্ধ মানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে হোস্টেলটির মতো- এটা আমি শুনেছি।’
Leave a Reply