অভাবের সঙ্গে লড়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছেন লালমনিরহাটের মিনারা জাহান মিষ্টি। স্নাতকে বিভাগে দ্বিতীয় আর স্নাতকোত্তরে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করেছেন নাটোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। তাঁর সংগ্রামের গল্প শুনেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
লালমনিরহাটের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে আমি, যেখানে শিক্ষা আর বিদ্যুতের আলো পৌঁছেছে অনেক দেরিতে। আমরা দুই বোন ও এক ভাই। অভাবের সংসার। টানাপড়েনের কারণে মাত্র দেড় বছর বয়সে নানি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসেন।
মামা-মামির সংসারে ছিলাম পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। বাড়িতে আসার পর বুঝলাম অভাব কী জিনিস। সংসারে কেবল নেই আর নেই। সেই সঙ্গে নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতি—মেনে নিতে পারছিলাম না।
সব সময় নিজের সঙ্গে নিজের একটি স্নায়ুযুদ্ধ চলত।
সেই মিনারা এখন বিচারকহরিদেব সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। শিক্ষকরা খুব স্নেহ করতেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বাড়িতে চলে এলাম।
বছরের বাকি সময়টা স্যাররাই আমাকে স্কুল থেকে বাসায় আনা-নেওয়া করতেন। কারণ বাসা থেকে স্কুল ছিল বেশ দূরে। পরে ভর্তি হলাম ফকিরের তকেয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। জীবনের দুরন্ত মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি এ সময়। জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ ৫সহ বৃত্তি পেয়েছি।
শহীদ আবুল কাশেম মহাবিদ্যালয়ে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে। এসএসসির আগে থেকেই মাথা ব্যথা বাড়ছিল। ফলে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতাম না। এমনকি ২০১৪ সালে এইচএসসির সময় পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে পারিনি মাথা ব্যথার কারণে। অনেক ডাক্তার দেখানোর পর জানলাম মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছি।
বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ মেলেনি। চাপা কষ্ট নিয়ে বাসে করে রাজশাহী থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ শুনলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। পেছনের সিটে বসা এক আপু আমার রোল নম্বর নিলেন। একটু পর তিনি রীতিমতো চিৎকার করে বললেন, “আরে আপনি তো ‘ল’ পেয়েছেন, আপনার পজিশন ৩২!” সব কষ্ট মুহূর্তেই উবে গেল।
কখনো মনে হতো আইনে পড়ব, কখনো ইংরেজিতে। এই দ্বিধা কাটছিল না। শেষমেশ ইংরেজি প্রথম পছন্দ দিয়ে ফরম পূরণ করতে গেলাম, কিন্তু ছবিতে চশমা থাকায় সেদিন আর হলো না ফরম পূরণ। পরদিন প্রথম পছন্দ দিলাম আইন। এখন মনে হয়, প্রথম দিন ফরম পূরণ করতে না পারাটা শাপে বর হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাবি) সুযোগ পেয়েছিলাম। কোথায় ভর্তি হব? তখনই সন্ধান পাই মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের। এক চাচাতো ভাই জবিতে ভর্তির জন্য মা-বাবাকে রাজি করালেন। তিনি মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে আবেদন করতেও সাহায্য করলেন। ফাউন্ডেশন থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত মাসিক বৃত্তি পেয়েছিলাম।
ঢাকায় বছর দুয়েক খুব খারাপ কেটেছে। হঠাৎ করে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। সঙ্গে মাথা ব্যথা তো আছেই। টানা ক্লাস করলে ব্যথা বাড়ত। রোজ ক্লাস করে গিয়ে মাথা ব্যথায় কাতরাতে হতো। বিছানায় কাটাতে হয়েছে অনেক দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যেতাম। ক্লাস থেকে ফিরে আবার শুয়ে পড়তে হতো—এত তীব্র ছিল মাথা ব্যথা। যন্ত্রণায় বেশির দিনই রাতে খাওয়াই হতো না। টানা ঘুমালে ব্যথা সেরে যেত। গল্পের বই দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকার অস্ত্র বলে মনে হতো। সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ পড়ে খুব আনন্দ পেয়েছি। যখন খুব ভেঙে পড়ি—সাতকাহনের দীপাবলির কথা মনে করি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাই। এসবের মধ্যেই স্নাতকে বিভাগে দ্বিতীয় আর স্নাতকোত্তরে যৌথভাবে প্রথম হয়েছি।
আইনে পড়ার সময় ঠিক করেছিলাম—বিচারক হব। জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এক বন্ধু ফোন করে জানায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। তখনো ঠিক বিশ্বাস হয়নি। প্রবেশপত্র বের করে নিজে মিলিয়ে দেখার পর খুশিতে কেঁদে ফেললাম!
মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র নাথ। তাঁর সম্পর্কে যত জেনেছি, অবাক হয়েছি। এটি এমনই এক প্ল্যাটফরম, যেটি একজন শিক্ষার্থীর মৃতপ্রায় স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে এবং বাস্তবে রূপ দেয়। আমিও চাই অভাবে ধুঁকতে থাকা শিক্ষার্থীর আনন্দের অংশীদার হতে। সেই চিন্তা থেকেই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আপাতত একজনের দায়িত্ব নেব বলে ঠিক করেছি।
গত ১০ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সহকারী জজ হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছে আমার। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গ্রামে থাকার সুবাদে এই বিষয়টি আরো গভীরভাবে বুঝেছি। চেষ্টা করব ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে।
Leave a Reply