সাবেক বিচারক, আইনজীবী এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন মনে করেন, আন্দোলন বা দাবির মুখে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা শতভাগ অন্যায় এবং বেআইনি। একজন বিচারপতি ওই আমলে নিয়োগ প্রাপ্ত, তাই তাকে বাদ দিতে হবে- এটা তো হতে পারে না। তিনি যদি তার পেশাগত দক্ষতা ও সততা দেখান, তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে কেন?
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন মনে করেন, আন্দোলন বা দাবির মুখে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা শতভাগ অন্যায় এবং বেআইনি।
এবার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের মুখে ১২ বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে বেঞ্চ থেকে প্রত্যাহার করেন নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
আইন বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, বেঞ্চ না দেয়ার মানে আসলে বিচারকদের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া।
তবে বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে বুধবার (১৬ অক্টোবর) সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাওকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ১২ বিচারপতির বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্তেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তারা চান বিচারপতিদের পদত্যাগ৷
রোববার (২০ অক্টোবর) বিকালের মধ্যে তাদের পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছে তারা। ওইদিন সকালে আপিল বিভাগে বিচারপতিদের অভিসংশনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের রিভিউ পিটিশনের শুনানি হওয়ার কথা।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছিল। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার আপিল বিভাগে আবার সেই রায়ের ব্যাপারে রিভিউ করে।
বুধবার যে ১২ জনের বিচারিক ক্ষমতা কার্যত কেড়ে নেয়া হয়, তারা হলেন: বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আকতারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলন, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি আতোয়ার রহমান, বিচারপতি খিজির হায়াৎ , বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি শেখ হাসান ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জণ।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কয়েকজনের সঙ্গে বৈঠকের পর সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাওকারী সমবেত ছাত্রদের সামনে গিয়ে বুধবার বিকালে ওই ১২ জন বিচারপতিকে কোনো বেঞ্চ না দেয়ার কথা জানান। তিনি বলেন,বিচারপতিদের পদত্যাগের আপনাদের যে দাবি, বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের, প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয়, উনি সেটা করেছেন। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেয়ার অর্থই হলো, তারা এই যে আগামী ২০ অক্টোবর কোর্ট খুলবে, তারা আর বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ বৃহস্পতিবার শেষ হবে। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর গত ৯ আগস্ট ৫০ জন বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করা হয় ‘সাধারণ আইনজীবীদের’ ব্যানারে। ১০ আগস্ট ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করা হয়। পদত্যাগ না করলে তারা প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের বাসভবন ঘেরাওয়েরও হুমকি দেয়। ওই দিন দুপুর ১টা পর্যন্ত তারা পদত্যাগের সময় বেঁধে দিয়েছিল। তাদের কথামতো ওই দিনই প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। গত মাসে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৩০ জন বিচারকের একটি তালিকা দেন৷ মির্জা ফখরুলের দাবি, ওই ৩০ জন দলীয় এবং দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।
মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ‘‘ফ্যাসিস্ট সরকারে সহযোগী ও দলবাজ” বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়। বুধবার সকালেই তারা সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ‘বৈষম্য বিরোধী আইনজীবীরা’।
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট’ বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে হবে। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের দোসরদের যদি কেউ পুনর্বাসন করতে চায়, তাদেরও প্রতিহত করা হবে। পুনর্বাসনের চেষ্টা যে-ই করবে, তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না। শহীদদের রক্তের সঙ্গে বে্ঈমানি চলবে না। ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিটি ঘটনার বিচার করতে হবে। শেখ হাসিনাসহ যারা বিদেশে পালিয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এই ঘেরাও চলার সময়ই প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দেন। তাদের মধ্যে ছয় জন পর্যায়ক্রমে দাওয়াতে যান। বাকি ছয় জন যাননি। আর দুপুরের পর সুপ্রিম কোর্টের রেজিষ্ট্রার ছাত্রদের দুই সমন্বয়কারীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই দুই সম্বয়ককে ১২ বিচারপতিকে আর বেঞ্চ না দেয়ার বিষয়ে জানানো হয়।
তবে বিচারপতিদের এই পদত্যাগের আন্দোলনের মধ্যে নতুন বিচারপতিও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৩ জন নতুন বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে হাইকোর্টে।
প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক। বিচার বিভাগকে অন্য সরকারি অফিসের মতো হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। এখন যেটা করা হচ্ছে, এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তো নিশ্চিত হবেই না, উল্টো মুখ থুবড়ে পড়বে।”
তার কথা, “বিচারপতিদের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তা নিস্পত্তির আইনি এবং সাংবাবিধানিক পদ্ধতি আছে। সেটা না করে এভাবে দাবির মুখে বিচারকদের সরিয়ে দেয়া যায় না।”
আর সাবেক বিচারক, আইনজীবী এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন বলেন, “আন্দোলন বা দাবির মুখে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা শতভাগ অন্যায় এবং বেআইনি। একজন বিচারপতি ওই আমলে নিয়োগ প্রাপ্ত, তাই তাকে বাদ দিতে হবে- এটা তো হতে পারে না। তিনি যদি তার পেশাগত দক্ষতা ও সততা দেখান, তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে কেন?”
তার কথা, “বেঞ্চ না দেয়ার ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির আছে। কিন্তু সেটা দাবি বা আন্দোলনের মুখে কেন হবে? তিনি চায়ের দাওয়াত দিয়ে এসব কেন করবেন? আগের প্রধান বিচারপতি তো ভয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এখনকার প্রধান বিচারপতির স্পষ্ট করে বলা উচিত ছিল- অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে। কোনো দাবির মুখে কাউকে পদত্যাগ করানো যাবে না। এখন যেটা করা হচ্ছে, তা একটা সভ্য জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য শুভ নয়।”
আর সাবেক বিচারক ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিষ্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, “এভাবে বিচারকদের পদত্যাগ করানো বা অপসারণ করা যায় না। এটা আইন ও সংবিধান মেনে করতে হবে। দাবির মুখে বা আন্দোলনের মুখে করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
বিচারকদের অভিশংসনের উপায়
বাংলাদেশের সংবিধানে বিচারকদের অভিসংশনের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংসদের হাতে দেয়া হয়। কিন্তু ওই সংশোধনী হাইকোর্ট বাতিল করে এবং প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে তখনকার আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। ওই রায়ের ব্যাপারে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার রিভিউ আবেদন করে, যার শুনানি এখনো হয়নি। মাসদার হোসেন মনে করেন, “এর ফলে বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের নিস্পত্তি বা তাদের অভিসংশনে এখন আইন ও সাংবিধানিক শূন্যতা আছে। এটা দূর করতে দ্রুত রিভিউ শুনানি করা দরকার। যদি শুনানিতে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে, তাহলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরে আসবে।”
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে হয়। সেখানে প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের আরো তিনজন বিচারপতি থাকেন।
তার কথা, “এই শূন্যতার কারণেই গত কয়েক বছরে পাচঁ-ছয় জন বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তাদের ছুটিতে পাঠিয়ে বাড়িতে বসিয়ে বেতন দেয়া হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “এখানে বিচারক নিয়োগেও কোনো নীতিমালা নাই । যে ২৩ জন নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলো, তাদের কিসের ভিত্তিতে দেয়া হলো? আমরা সংস্কার কমিটি সাত দিনের মধ্যে নীতিমালা করতে পারতাম। কিন্তু তার অপেক্ষা করলো না।”
তবে ইকতেদার আহমেদ মনে করেন, “এখন পর্যন্ত অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতেই আছে। কারণ, সংসদের আইন আদালত বাতিল করতে পারে না। হয় নতুন করে সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হবে, অথবা আগামী সংসদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”
কিন্তু মনজিল মোরসেদ মনে করেন, “ষোড়শ সংশোধনী যেহেতু আপিল বিভাগও বাতিল করেছে, তাই এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল আছে। ফলে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করতে পারে। কারণ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রিভিউ করলেও হাইকোর্টের রায় বাতিল করেনি আপিল বিভাগ। স্থগিতও করেনি।”
Leave a Reply