পাঁচ দিন আগে ফুটফুটে মেয়েসন্তানের বাবা হয়েছিলেন। নিজের নাম অনুসারে মেয়ের নাম মাসুমা রাখার ইচ্ছে ছিল। সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে স্ত্রী বিউটি আরার সিজারিয়ান অপারেশন হওয়ায় তিনি অসুস্থ। বাবা বেঁচে নেই। অসুস্থ মা শয্যাশায়ী। নিজেও ছিলেন পঙ্গু। তার কষ্টের পৃথিবীতে আশার প্রদীপ হয়ে এসেছিল কন্যাসন্তানটি। এজন্য খুশিতে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে নিজের এবং মেয়ের জন্য দোয়াও চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজেই পৃথিবীতে আর বেশিদিন বাঁচতে পারলেন না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ হয়তো বছর গড়ালেই ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটির আলতো ঠোঁটে বাবা ডাক শুনতেন। কিন্তু সুযোগ তিনি পেলেন না।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাতে শিশুসন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নগরীর বিনোদপুর এলাকায় গণপিটুনির শিকার হন। আহত অবস্থায় মতিহার ও বোয়ালিয়া থানায় নেয়ার পর অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই গভীর রাতে মারা যান।
মাসুদের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়। বাবা নেই, মা শয্যাশায়ী। পৃথিবীতে মাসুদের মা, স্ত্রী আর চার দিনের সন্তানটি ছাড়া আর কেউ নেই। কাছের বলতে একজন মামা আছেন। মামার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদকর্মী পরিচয় দিতেই ফোনের ওপার থেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘এই মুহূর্তে কথা বলার মতো কোনো পরিস্থিতিতে নেই আমি। ভাই পরে কথা বলবো। দোয়া রাখবেন। পরে যোগাযোগ করবেন।’
গত শনিবার নবজাতক শিশুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মাসুদ লিখেছিলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার। গত ৩-৯-২০২৪ তারিখে কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছি। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে নেক হায়াত ও সুস্থতা কামনা করি। সব আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার ও আমার মেয়ের জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি।’
যা ঘটেছিল
বোয়ালিয়া থানার ওসি এস এম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে শনিবার রাতে বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা করা হয়। পরে একদল শিক্ষার্থী তাকে প্রথমে মতিহার থানায় নিয়ে যান। কিন্তু মতিহার থানায় ৫ আগস্টের সহিংসতার কোনো মামলা নেই। তাই বোয়ালিয়া থানায় আনা হয়, যেন কোনো সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু তার অবস্থা ছিল গুরুতর। শারীরিক অবস্থা দেখে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মৃত্যু হয়। এখন পরিবার চাইলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নগরীর বিনোদপুর বাজার এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মী ও ছাত্ররা মাসুদকে ধরে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকেন। এতে গুরুতর আহত হন। পরে পেটাতে পেটাতে থানায় নেয়া হয়। আগে থেকেই একটি পা না থাকায় প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। অন্য পা শনিবার রাতে ভেঙে দেয়া হয়। ওই অবস্থায় থানায় নেয়া হয়। মাসুদকে যখন আনা হয়, তখন বোয়ালিয়া থানায় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। ৫ আগস্ট এক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দুই যুবককে ধরে থানায় এনেছিলেন তিনি। থানায় তিনিও মাসুদকে দেখেন। পরে তাকে থানা হাজতে রাখা হয়। পরে হাসপাতালে নেয়া হয়।
আহত অবস্থায় বোয়ালিয়া থানায় আনার পর তার কথাবার্তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। থানা হাজতে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাসুদকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বিনোদপুরে ওষুধ নিতে এসেছিলাম ভাই। আমি ছাত্রলীগ করতাম ওই জন্য ধরেছে। কিন্তু আমার পা ২০১৪ সালে কেটেছে ভাই। রগটগ সব কাটা ভাই। আমি তো অনেক দিন আগে থেকেই ছাত্রলীগ করা বাদ দিয়েছি ভাই।’
মাসুদের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র শংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘কী কারণে মাসুদ মারা গেছেন, সেটি ময়নাতদন্তের পর বলা যাবে।’
যা বলছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা
মাসুদের মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘আমরা যে দুজনকে নিয়ে থানায় গিয়েছিলাম, তাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তার মধ্যে আহত অবস্থায় একজনকে আনতে দেখলাম। কিন্তু কারা তাকে এনেছিল, তা চিনতে পারিনি। শুধু শুনলাম ছাত্রলীগের কর্মী ধরা পড়েছে, বিভিন্ন জায়গায় যে রকম ধরা পড়ছে। এরপর কেউ যাতে না মারে, সে জন্য তাকে থানা হাজতের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। পরে কী হয়েছে, তা আমি জানি না। সকালে শুনলাম তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাবি শাখার সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমার আন্দোলন হলো মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে। কোনও মানুষ যদি অপরাধীও হয়, মবের অধিকার নেই সেই বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার। আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো, আইন তার গতিতে চলবে। এভাবে মবের মধ্যে একজন মানুষের মৃত্যু হওয়াটা খুবই দুঃখজনক এবং কষ্টদায়ক। এই ধরনের হামলার অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।’
কে দেখবে মাসুদের পরিবারকে?
ছোট্ট কন্যাশিশু ও মাসুদের পরিবারকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে ছাত্র উপদেষ্টা ড. আমিরুল ইসলাম কনক বলেন, ‘উপাচার্যের পরামর্শে আমি এবং প্রক্টর মিলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তার পরিবারে চার দিন বয়সের একটি কন্যাসন্তান, স্ত্রী ও তার অসুস্থ মা রয়েছেন। তার স্ত্রীর চার দিন আগেই সিজার হয়েছে। তারা তাদের নিজ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে গেছেন। এখানে অভিভাবক বলতে তার মামা রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী তার শিশুর ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে সেই পরিবারটির জন্য আমরা সাহায্য করবো।’
বিচার চেয়েছেন অনেকে
এদিকে আব্দুল্লাহ আল মাসুদের এমন মৃত্যুর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা সমালোচনা। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহিদ নেওয়াজ খান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এক পোস্টে বলেন, ‘রাজশাহীতে পিটিয়ে পঙ্গু মানুষটাকে মেরে ফেলা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এরকম বর্বর খুনিদের হাতে জুলাই-আগস্ট মাসে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন। ওরা ছিল পোশাকে, এরা পোশাক ছাড়া। এটাই পার্থক্য। তিন দিন আগে পিতা হওয়া মানুষটার বাচ্চাটা জীবনেও জানবে না বাবা কী জিনিস। মাসুদের প্রত্যেকটা খুনিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে- যেমন জুলাই-আগস্ট মাসের খুনিদের। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের এক মাসেরও বেশি সময় পর একটা হত্যাকাণ্ডকে জনরোষ বলার সুযোগ নেই। জনরোষও কোনও যুক্তি না। আগের সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কতটা মানবিক, কতটা মানবাধিকারে বিশ্বাসী, সেটা বোঝা যাবে পঙ্গু মাসুদ হত্যাকাণ্ডে সরকার কত দ্রুত কী ব্যবস্থা নেয় তার ওপর।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চরম বর্বরোচিত এবং জঘন্য। সে যেই হোক না কেন আর তার বিরুদ্ধে যত বড় অভিযোগই থাকুক না কেন, এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমি ধিক্কার জানাই। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারও নেই।’
হয়নি মামলা
এদিকে, মাসুদ নিহতের ১৮ ঘণ্টা পরও পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা কিংবা আইনি সহায়তা পাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর বোয়ালিয়া থানার ওসি এস এম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘আমাদের এখানে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তার বিষয়ে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া মতিহার থানায় হবে, সেখানে কেউ মামলা দায়ের করছে কিনা, আমি জানি না। এখন পরিবার চাইলে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে মতিহার থানার ওসি আরিফুল ইসলামের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এজন্য সে থানায় মামলা হয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি।
আগেও হামলার শিকার হয়ে পা হারিয়েছেন, পাননি বিচার
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য। তিনি নগরীর বুধপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। এ সময় মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাঁ পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল হাতের রগ। দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও সে ঘটনার বিচার পাননি মাসুদ।
চাকরি দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন মাসুদ। এরপর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মীর তাফেয়া সিদ্দিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে মাসুদকে নিয়োগ দিতে বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিয়োগপত্র পেয়ে ২২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগ দেন। সেই থেকে এই পদেই চাকরি করতেন।
Leave a Reply