মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ফিল্মি স্টাইলে ফের অপহরণের শিকার হয়েছেন রোহিঙ্গা সাত নারী ও শিশু এবং এক বাংলাদেশি যুবক। এ ঘটনা তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো সন্ধান মেলেনি তাদের।
জানা গেছে, কক্সবাজার সদর থানার পশ্চিম লারপাড়ার ১ নং ওয়ার্ড বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে দিনেদুপুরে এক রোহিঙ্গা পরিবারের ৭ সদস্য ও এক বাংলাদেশিসহ ৮ জনকে বাসা থেকে কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় একদল সশস্ত্র লোক।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের একজন কক্সবাজার সদর থানা, র্যাব ও ডিবি কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অপহৃতরা হলেন- বাংলাদেশি আবদুল মালেকর ছেলে আবদুল হামিদ (৪১), রোহিঙ্গা মৃত আলী আহমদের স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৯), তার মেয়ে রোজিয়া বেগম (১৮), রোকেয়া বেগম (১৩), জয়নব বেগম (৮), ছেলে মোহাম্মদ শাহ (১১), মোহাম্মদ (৪) ও রোহিঙ্গা ছাবুত আলমের ছেলে সাদেক (৩৮)।
কক্সবাজার সদর থানায় অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অভিযোগকারী মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের ঠাকুর তলার বাসিন্দা রূপবান খাতুন একজন ৬০ বছরের বৃদ্ধা। অপহৃত আবদুল হামিদ তার একমাত্র ছেলে। তারা একসঙ্গেই থাকেন।
বৃদ্ধার ছেলে আবদুল হামিদ এক রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করেন। পুত্রবধূর নিকটতম আত্মীয় হওয়ায় একই পরিবারের ৭ রোহিঙ্গা টেকনাফ থেকে কক্সবাজারের লারপাড়ায় হামিদের বাসায় আশ্রয়ের সন্ধানে আসার পথে গত ২৩ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে কলাতলী মোড় থেকে নাম-পরিচয়হীন অজ্ঞাতনামা একদল লোক তাদের তুলে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়। হঠাৎ ২৬ আগস্ট অপহৃত আবদুল হামিদের স্ত্রীর মোবাইলে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে জানায়, অপহৃতদের কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় একটি কক্ষে আটক করে রাখা হয়েছে। তারা মুক্তিপণ হিসেবে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। একদিনের মধ্যে মুক্তিপণ দেওয়া না হলে এবং কোনো প্রকার চালাকি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিলে অপহৃতদের মেরে ফেলার বলে হুমকি দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ২৯ আগস্ট দুপুর ৩টায় কলাতলী থেকে এলাকাবাসীর সহায়তায় হামিদ এবং ঐ অপহৃত ব্যক্তিদের ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে তারা লারপাড়ায় হামিদের ভাড়া বাসায় যান। এর এক ঘণ্টার মধ্যে বিকেল ৪টার দিকে হঠাৎ অপরিচিত ৮-১০ জন লোক ডিবি পরিচয় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে হামিদ ও তার স্ত্রীর আত্মীয়, ভাই, বোন এবং বোনের ছেলেসহ মোট ৮ জনকে ফের তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন রূপবান।
ঘটনার পরপর বৃদ্ধা ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কক্সবাজার সদর থানা, ডিবি অফিস, র্যাব অফিসসহ সবজায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরেও এখন পর্যন্ত তাদের পাওয়া যায়নি। ঐ ঘটনার সময় ডিবি পরিচয় দেওয়া লোকদের সিসিটিভি ফুটেজে ভিডিও ধারণ করা আছে। অপহরণের সময় ব্যবহৃত কালো রঙের ভক্সি মাইক্রোবাস গাড়ির নাম্বারসহ সংরক্ষিত আছে।
এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী হামিদের স্ত্রী, সাদেকের মা, তার ভাই আনোয়ার ও ভাগ্নে ইমতিয়াজের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সত্যতা জানা যায়।
প্রত্যক্ষদর্ষী হামিদের স্ত্রী রাজিয়া জানান, তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী ও তার ২ কিশোরি মেয়ে এবং ৩ শিশু টেকনাফ থেকে আমার বাসায় আসার পথে কক্সবাজার কলাতলী মোড় এলাকা থেকে তাদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিপণের মাধ্যমে উদ্ধার করে বাসায় আনার ১ ঘণ্টার মধ্যে আবার ডিবি’র পরিচয় দিয়ে তাদের একপ্রকার জিম্মি করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আমার স্বামী হামিদ ও সাদেককেও গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনার প্রায় ৩ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও অপহৃতদের কোনো হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সাদেকের মা, আনোয়ারা ও ইমতিয়াজ নামের এক যুবক জানান, তাদেরকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করার খবরে আমরা হামিদের বাড়িতে আসি। এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে অপহৃতদের ছেড়ে দেওয়া হবে এই সংবাদে আমরা আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ১ লাখ টাকা নিয়ে গত ২৯ আগস্ট হামিদের লারপাড়ার ভাড়া বাসায় আসি। হামিদ রমজান নামক এক লোকের মাধ্যমে ১ লাখ টাকা দিয়ে অপহৃতদের উদ্ধার করে বিকেল ৩টার দিকে বাসায় আসলে, এর ১ ঘণ্টা পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে অপহৃত ৬ জনের সঙ্গে সাদেক ও হামিদকেও নিয়ে যায়।
কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মসিউর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভুক্তভোগীদের একজন হামিদের মা রূপবান খাতুন একটা অভিযোগ করেছেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন স্থানে নজরদারি শুরু করেছি। অতিদ্রুত একটি ফল পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
উল্লেখ্য, দেড় মাস আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিদং ৭ নং ওয়ার্ড থেকে পাহাড়ি পথে ২৭ দিন হাঁটার পর গত ২০ আগস্ট নাফনদী অতিক্রম করে দালালের মাধ্যমে হ্নীলার মোচনী ক্যাম্পে আসে অপহরণের শিকার এই রোহিঙ্গা পরিবার। পরে দালালরা তাদের কুতুপালং কচুবনিয়ার এক বাসায় নিয়ে যান। সেখান থেকে হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের।
Leave a Reply