যে কারণে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যা, দায়ী কারা!

আকস্মিক বন্যায় ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলের ১০টি জেলা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩৬ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই করুণ, যা কল্পনাতীত। এ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বন্যা হয়েছে। সিলেট অঞ্চলেও বন্যা হয়েছে। এবার হলো চট্টগ্রাম বিভাগে।

কেন এই পরিস্থিতি হলো
বাংলাদেশে ও ত্রিপুরা রাজ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যার জন্য আবহাওয়াসম্পর্কিত ৪টি প্রধান কারণ খুঁজে পাওয়া যায় প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে। ১. এল-নিনো ২. মেডেন-জুলিয়ান বা সংক্ষেপে এমবেও ৩. জেট স্ট্রিম ও ৪. বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘু চাপ।

আবহাওয়াসম্পর্কিত এই চারটি কারণই পৃথকভাবে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। দৈবক্রমে আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে একই সঙ্গে ৪টি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময় সক্রিয় অবস্থায় উপনীত হয়ে ৪টি বৈশিষ্ট্যের মিলিত প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে।

আমরা কেন জানতে পারলাম না
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বর্তমানে ৩ থেকে ১৫ দিন পূর্বের আবহাওয়া পূর্বাভাস করা যায় অনেক নিখুঁতভাবে। ৩ দিন আগে থেকে শতকরা ৯০ ভাগ নিশ্চয়তা সহকারে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়।

এ সপ্তাহে যে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হলো, তার পূর্বাভাস ১০ দিন পূর্বে দেওয়া সম্ভব ছিল। বাংলাদেশের মানুষকে ভারী বৃষ্টির এই পূর্বাভাস জানাতে ব্যর্থতার জন্য পুরোপুরি দায়ী আবহাওয়া অধিদফতর। কেন আবহাওয়া অধিদফতর এই পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হলো, সেই ব্যাখ্যা আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদদের কাছে জানতে চাওয়া উচিত।

বাংলাদেশে ও ভারতে বৃষ্টির পরিমাণ
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য অনুসারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ দিনে মোট ৪৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৪৫ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় ৪০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বাগাফা নামক স্থানে ৩৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যে স্থান বাংলাদেশের ফেনী জেলার পাশেই অবস্থিত।

এই বৃষ্টিপাত ফেনী জেলার মুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই দিনে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যান্য স্থানে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি নামক স্থানে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে যা বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার সুরমা নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের বৃষ্টিপাত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে ফেনী, কুমিল্লা ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর গড়ে ৪৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে ৩ দিনে।

এখানে উল্লেখ্য যে আগস্ট মাসে কুমিল্লা জেলায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩৪৭ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০৩ মিলিমিটার। অর্থাৎ ১৯ আগস্ট থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৩ দিনে কুমিল্লা ও ফেনী জেলায় মোট যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা এই দুই জেলার আগস্ট মাসের মোট বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। এই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিই হলো রেকর্ড পরিমাণ বন্যার প্রধানত কারণ।

বন্যা ও ত্রিপুরায় বাঁধ খুলে দেওয়া
কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক বাঁধ দিয়েছে দেশটির সরকার। সেখানে আছে ব্যারেজও। এসব বাঁধ ও ব্যারেজের কোনোটি পানি সংরক্ষণের জন্য, কোনোটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কিংবা কৃষিকাজের জন্য।

যেহেতু জুন মাসে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে, তাই ১৮ আগস্টের আগেই এসব ড্যাম ও ব্যারাজ পানিতে পূর্ণ ছিল। ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ত্রিপুরা রাজ্যের সব ড্যাম ও ব্যারাজের পানি ধারণক্ষমতার সীমায় পৌঁছে যায় এবং ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই বেশির ভাগ ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেয় ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ।

ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা ভারত সরকার ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারকে ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া সম্পর্কে আগে থেকে কোনো রকম তথ্য দেয়নি বা দিতে ব্যর্থ হয়।

এমন পরিস্থিতি থাকবে যতদিন
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার পর থেকে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোর ওপর বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ওপরও বৃষ্টিপাত পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোর ওপর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে যে শুক্রবার দুপুরের পর থেকে কুমিল্লা জেলার গোমতী নদী ও ফেনী জেলার মুহুরী নদীর বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়া শুরু করবে। তবে বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নতির জন্য আগামী রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আশা করা যাচ্ছে, রোববার থেকে বন্যাদুর্গত মানুষেরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরা শুরু করতে পারবেন।

উল্লেখ্য, মেডেন-জুলিয়ান নামক আবহাওয়া চক্রটি আগামী দুই সপ্তাহ ভারত মহাসাগরের ওপর সক্রিয় অবস্থায় থাকবে, যার প্রভাবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর নিয়মিত বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *