জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্য নিয়ে যা বললেন শায়খে চরমোনাই!

জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নয়া জোট বা মোর্চা গঠনের উদ্যোগের বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই বলেছেন, আমরা জামায়াতে ইসলামীর আরও অনেক আগে থেকে এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি।

সম্প্রতি দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আপনাদের মতাদর্শগত বিরোধ রয়েছে, এটা কি ঠিক-জবাবে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের মতাদর্শগত বিরোধ, এটা শুরু থেকেই। এখনো আছে। শুধু আমাদের সঙ্গেই নয়, আরও অনেকের সঙ্গেই তাদের আদর্শগত মতবিরোধ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন আছে, ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে, আকিদার প্রশ্ন আছে। এছাড়াও ওলামায়ে কেরামের মতামতের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতা মওদুদী সাহেবের যে মতামত, তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কওমি, পির-মুরিদ-এসব ইস্যুতেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে।

ফয়জুল করীম বলেছেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল, কেউই এই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পরেনি। দুর্নীতি-দলীয়করণ-দুঃশাসন উপহার দেওয়াসহ দেশ পরিচালনায় তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নীতি ও আদর্শের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা তাই শুধু নেতা নয়, নীতিরও পরিবর্তন চাই।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে তিনি আওয়ামী লীগ আমলের অনিয়ম, দুর্নীতি, দলীয়করণ, দুর্নীতিবাজদের বিচারের দাবি জানানোসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার ভাবনার বিষয়গুলোও অকপটে তুলে ধরেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, নতুন প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্র সংস্কার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনি জোট গঠনসহ নানা বিষয় উঠে আসে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের বক্তব্যে।

শেখ হাসিনার বিদায়-পরবর্তী আগামী দিনের কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে অন্যরকম এক অবস্থা ছিল। ভয়ভীতি, দমন-পীড়নের পাশাপাশি দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারের মহোৎসব চলছিল দেশে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানো। দেশে সাম্য কায়েম করা, বৈষম্য দূর করা। মানুষের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার ফল ৫ আগস্ট-পরবর্তী আজকের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের কাজ হবে মানুষের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করা।

পরিবর্তনের অর্থ কি আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপি, কিংবা আওয়ামী লীগের সময়ে যা হয়েছে, এরই পুনরাবৃত্তি-এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, আসলে দেশের মানুষ চেয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। সর্বক্ষেত্রে জনগণের অধিকারের বাস্তবায়ন। এ জনগণ সে হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলিম কিংবা অন্য কোনো ধর্মের হোক-সবার অধিকারের বাস্তবায়ন চায় দেশের মানুষ। এজন্যই তো এত আত্মত্যাগ। কত মানুষ শহিদ হয়েছেন, কত নারী বিধবা হয়েছেন, কত সন্তান এতিম হলো-এসব আমলে না নিয়ে ৫ আগস্টের পরপরই আমরা দেখলাম, লুটপাট-দখলদারি-চাঁদাবাজি। আগের সেই চরিত্রেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সুযোগসন্ধানী একটি চিহ্নিত মহল, এর সঙ্গে বিএনপির কিছু নেতাকর্মী মিলে এসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে, যা সত্যিই দুঃখজনক।

একজন ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না-বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমন দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির বলেন, চোর এক বছর থাকলেও চুরি করবে। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও চুরি করবে। আর সৎ ও আদর্শবান মানুষ একশ বছর থাকলেও তিনি আদর্শভিত্তিক দেশ চালাবেন। আসলে আমাদের ভাবনায়ই গলদ রয়েছে। আমরা খারাপ লোকের মাধ্যমে দেশটাকে ভালো বানাতে চাই, এটাই সমস্যা। আজ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে যদি তাকাই, দেখা যাবে-সেখানে যারা ভিসি (উপাচার্য) কিংবা শিক্ষক রয়েছেন, তারা সবসময় অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে গেছেন। অথচ মানুষ তাদের কাছে এমনটা প্রত্যাশা করে না। সময় এসেছে, আমাদের কালোকে কালো বলতে হবে। সাদাকে সাদা বলতে হবে। রাতকে রাত, দিনকে দিন বলতে হবে। আপনার সন্তানও যদি অন্যায় করে, তাহলে বলতে হবে সে অন্যায়কারী। আর ভালো কাজ যদি আপনার দুশমনও করে, তাহলে বলতে হবে, সে আমার দুশমন হওয়া সত্ত্বেও কাজটি ভালো করেছে। আমি আসলে বোঝাতে চাইছি যে মান্দার গাছ লাগিয়ে আমাদের আমের আশা করা যাবে না। আম খেতে চাইলে আমগাছই লাগাতে হবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবি সম্পর্কে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, শুধু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাই নন, তার সহযোগী সব দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, লুটপাটকারী, অর্থ পাচারকারীর বিচার চাই। একই সঙ্গে যারা দুর্নীতি-লুটপাট ও অর্থ পাচারের কাজে সহযোগিতা করেছে বা সাহায্য করেছে, যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়; তাদেরও বিচার চাই। আমরা মনে করি, তারা সবাই একই দোষে দুষ্ট। তারাও সমান অপরাধী। তবে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটায়ও খেয়াল রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন-এমন অনেক ভালো মানুষ আছেন, যারা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত না, দুর্নীতি, লুটপাট, জুলুম, অত্যাচার করেননি, চুরি-ডাকাতি করেননি-তাদের হয়রানি যাতে না করা হয়, এটাও দেখতে হবে। অনেকের শিল্পপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এগুলো দেশের সম্পদ। দেশের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। একইভাবে অনেকের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলো আগের ফ্যাসিস্ট সরকারেরই পুনরাবৃত্তি।

অনেকেই ইসলামি কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছেন, কী মনে করেন আপনি-জবাবে তিনি বলেন, এরকম দাবি যারা জানায়, তাদের বিচার হওয়া উচিত। তারা সেকুলার রাজনীতি বন্ধের দাবি জানায় না, তারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন না। এমনকি কমিউনিস্ট রাজনীতি বন্ধের দাবি জানায় না, তারা একটি দেশের ৯২ ভাগ মানুষ যেখানে মুসলমান, সেখানে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। এরা এই মাটি ও মানুষের লোক না। এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে না। এরা ভিন্ন এক গ্রহের লোক। এদের বিচার হওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *