জাবি ছাত্রলীগ নেতা হত্যা, নেতৃত্বে ছাত্রদলের নেতাকর্মী!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ বুধবার ক্যাম্পাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিকালে ও সন্ধ্যায় তাকে গণপিটুনি দেয় শিক্ষার্থীরা।

তবে মারধরের নেতৃত্ব দেয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এটিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা আখ্যা দিয়ে জড়িতদের বিচার দাবিতে গভীর রাতেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে বৃহস্পতিবারও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে চলে বিক্ষোভ। এর মুখে তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল। তবে তখন পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি। কাউকে আটক বা গ্রেফতারের তথ্যও পাওয়া যায়নি।

নিহত শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি আশুলিয়া থানার কাঠগড়া এলাকার মোল্লাবাড়ীর ইয়াজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকসংলগ্ন একটি দোকানে অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাকে আটক করে। ১৫ জুলাই রাতে জাবি উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকা এবং শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে গুলি ছোড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহসান লাবীব। হামলায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করলে শামীমকে গণধোলাই দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ ভূঁইয়ার নির্দেশে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আতিককে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।

খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় শামীমকে নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। তাকে নিরাপত্তা শাখায় আনার খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সেখানে জড়ো হয়। সেখানেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তখন শামীমকে নিরাপত্তা শাখার ভেতরে নিয়ে গেটে তালা দিয়ে রাখা হয়। তবে গেটের তালা ভেঙে তাকে আবারও গণধোলাই দেন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তা থেকে নিরাপত্তা অফিসের তালা ভাঙা ও শামীমকে বেধড়ক মারধরে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজনকে চিহ্নিত করা গেছে। তারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী সাঈদ হোসেন ভূঁইয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ ও ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাজন হাসান, ইংরেজি ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হামিদুল্লাহ সালমান এবং কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এমএন সোহাগ। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে শামীম মোল্লাকে মারধরের বিষয়টি যুগান্তরের কাছে অস্বীকার করেছেন তারা। এছাড়া সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককেও দেখা গেছে, তবে তারা মারধরে অংশ নিয়েছে কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পরে সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান প্রক্টর অফিসে আসেন। তিনি উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শামীমের শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দেন। পরে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের খবরে আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল নিরাপত্তা শাখায় আসেন। পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ১৫ জুলাই রাতে উপাচার্যের বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয়ে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর তাকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ শামীমকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শামীম মোল্লার মৃৃত্যুর বিষয়ে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সেলিমুজ্জামান বলেন, ‘তাকে (শামীম) রাত সোয়া নয়টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আমরা পরীক্ষা করে জানতে পারি, উনি মারা গেছেন। মূলত উনি আগেই মারা গিয়েছিলেন। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তা ময়নাতদন্ত করে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের থেকে খবর পেয়ে আমাদের আশুলিয়া থানা পুলিশের একটি দল ক্যাম্পাসে যায়। তারা আমাদের কাছে শামীম মোল্লা নামে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে সোপর্দ করে। সে শিক্ষার্থীদের গণপিটুনিতে আহত ছিলেন। তাই তাকে সাভারের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

ময়নাতদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শামীম মোল্লার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু রিপোর্ট আমরা এখনো হাতে পাইনি। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক একেএম রাশিদুল আলম বলেন, ‘শামীম মোল্লাকে যখন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন সে হেঁটেই গাড়িতে ওঠে। তবে কিছুক্ষণ পর পুলিশের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করা হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হবে। তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।’

বিক্ষোভ, বিচার দাবি : বুধবার রাত ১২টার দিকে শামীমের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাত দুইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি তাপসী বলেন, ‘স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা বিচারবহির্ভূত যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে। কেউ যদি অপরাধ করে তাহলে তাকে রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু কাউকে বিচারবহির্ভূতভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলাকে আমরা সমর্থন করি না।’

একই দাবিতে বৃহস্পতিবার পৃথক তিনটি ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মহুয়া মঞ্চ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।

সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী শাসনামলে রাজনীতি করার অন্যতম প্রক্রিয়া ছিল লাশের রাজনীতি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি লাশ পড়েছে যা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন রাজনীতি। যারা রাজনীতি শুরু করেছে তারা মূলত স্বৈরাচারের দোসর অথবা তাদের প্রক্রিয়া স্বৈরাচারেরই মতো। বুধবার রাতে যে ঘটনা ঘটেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে জড়িয়ে এই প্ল্যাটফর্মকে বিতর্কিত করার অপপ্রচেষ্টা চালানোর ঘটনায় নিন্দা জানাই।’

শামীম মোল্লার মৃত্যু ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ অ্যাখ্যা দিয়ে এদিন দুপুর ১২টায় জাহাঙ্গীরনগর বাঁচাও আন্দোলনের ব্যানারে ও বিকাল সাড়ে তিনটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যানারে পৃথক দুটি বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *